.bmp)
দ্বৈত অর্থনীতির চিন্তা থেকে শুরু। ছয় দফার হাত ধরে গুটি গুটি পা ফেলে স্বাধীকারের দিকে ছুটে চলা। বিজয় এসেছে একরাশ স্বপ্ন আর নতুন দিনের বার্তা নিয়ে। অর্থনৈতিক শোষণই এ স্বাধীনতাকে যৌক্তিক পরিণতির স্বাদ এনে দিয়েছে।কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির দেখা পাওয়া বরাবরই সূদুর পরাহত রয়ে গেল। প্রায় চার দশক পর আজকের বাংলাদেশে নিজেকে যখন এ প্রশ্নের মুখোমুখী করি “কি নেই যার জন্য আমরা পারলাম না?” তখন চোখের সামনে সব কিছু ছাপিয়ে ভেসে ওঠে আমাদের অর্থনীতির কিছু গঠনগত (structural) সমস্যা।
শিল্প আমাদের করতেই হবে। যারা একদিন আমাদের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল এবং শিল্প করে এখন সেবাখাতের দিকে এগোচ্ছে তারা কিভাবে করেছে? অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর রেসিপিটা হচ্ছে আগে কৃষি বিপ্লব তার পিছে পিছে শিল্প বিপ্লব এবং তারপর সেবা খাতের বিকাশ। আমাদের দেশে কৃষির বিপ্লবটা দেখার আগেই যখন একধাপ ডিঙ্গিয়ে সেবা খাতের বিকাশ শুরু হল তখনও শিল্প শৈশবে হামাগুঁড়ি দিচ্ছে। এই প্যাটার্নটা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত বৈষম্যকেই নাঙ্গা করে তুলে ধরছে। ধরা যাক, আজকের শিল্পন্নোত দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের কথা। তাদের আজকের শিল্পন্নোত অবস্থার পেছনে রয়েছে অভূতপূর্ব কৃষিবিপ্লব।
আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনের স্লথ গতি এবং তদসংশ্লিষ্ট ব্যাপক উৎপাদন উপকরণের (প্রধানত ভূমি) বৈষম্য অব্যাহত রেখেই শিল্পের দিকে রওনা করা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল নয়। সংবিধানে বর্ণিত সামাজিক সুবিচারের প্রশ্ন ছাড়াই শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির খাতিরেই আমাদের যে কাজটি করতেই হবে তা হচ্ছে ভূমি ও কৃষি সংস্কার। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সপ্তম অনুচ্ছেদের চতুর্থ পয়েন্টে মূলত এই বাস্তবতাকেই অক্ষরে অক্ষরে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
ভূমি ও কৃষি সংস্কার কিভাবে হতে পারে সেটি নিসঃন্দেহে একটি ব্যপক বিতর্ক সাপেক্ষ বিষয়। নতুন কোন বিতর্কের উদ্ভব না ঘটিয়েই বলতে চাই বাজার বা মূল্য ব্যবস্থা (price mechanism) ভিত্তিক ভূমি সংস্কার এখন আর কোন কল্পিত বিষয় নয়। অনুপস্থিত ভূমিমালিকানার পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যে বহু লোকই পাওয়া যাবে এমন যাদের জন্য কোন উন্নততর সুযোগ বা প্রণোদনা সৃষ্টি সম্ভব হলে তারা সহজেই জমি বেচতে চাইবে। সরকারের পয়লা কাজ হওয়া উচিত এই সব অনুপস্থিত ভূমিমালিকদের জমি এক্ত্র করে “ভূমি ব্যাংক” তৈরি করা।
সরকারের মোট খাস জমির কোন পরিসংখ্যান পাওয়া দুস্কর হলেও ডঃ আবুল বারকাতের অনুমান হচ্ছে ৫ লক্ষ একর। এই সব বেহাত হওয়া অথবা পতিত বেকার পড়ে থাকা জমি যদি যোগ দেয়া হয় “ভূমি ব্যাংক” এ তবে পরিমাণটা বেশ বড়ই হবে। এবার আসা যাক বিতর্কের কেন্দ্রস্থল ভূমির উর্ধ্বসীমা (ceiling) প্রসঙ্গে। অবশ্যই বর্তমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভূমির উর্ধ্বসীমা আরো কমিয়ে আনার দাবি রাখে কিন্তু বিপুল ম্যান্ডেট ধারী এ সরকার যদি বর্তমান উর্ধ্বসীমাই বাস্তবায়নে সক্ষম হয় এবং তা যুক্ত হয় “ভূমি ব্যাংক” এ তবে নিঃসন্দেহে বিপুল পরিমাণ জমি পাওয়া যাবে। বন্টনের ক্ষেত্রে এই সব জমি দেয়া উচিত সেই সব কৃষককে যাদের কিছুটা জমি আছে (গবেষণায় প্রাপ্ত পরিমাণ ১.৫ একরের বেশী)। একদম ভূমিহীন কৃষককে জমি দেবার সম্ভাব্য পরিণতি হচ্ছে জমি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যে পারি জমানো।সরকার “ভূমি বন্ড” ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদে জমির দাম বিক্রেতাকে পরিশোধ করতে পারে। যারা নির্দিষ্ট হারে খাজনা পেয়ে অভ্যস্থ তারা এতে খুশি হওয়া উচিত অন্তত এটা ভেবে যে, বর্গাচাষীদের কাছ থেকে খাজনা পাওয়ার অনিশ্চয়তা এখানে নেই। অন্যদিকে সরকার অর্থ সংস্থান করতে পারে কৃষকদের দেয়া জমির ব্যাপারে চুক্তি ভিত্তিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে অথবা শিল্প করতে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া জমির দাম থেকে।
এভাবে জমির পরোক্ষ পুনর্বন্টন প্রকৃতিগতভাবেই সমতাভিমুখী হওয়ায় একটি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি (sustainable growth) অর্জনে খুবই সহায়ক। এতে একদিকে বর্গাচাষীদের এক বিরাট অংশ একপ্রকার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে,যা তাদেরকে শ্রম বিক্রি করতে উদ্বুদ্ধ করবে; অন্যদিকে এই উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিই কৃষি বিপ্লবের সম্পূরক হিসেবে একটি শ্রমঘন পল্লী শিল্পায়নের চালিকা শক্তিতে পরিণত হবে।এখন এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে ক্ষুদ্র মালিকদের উৎপাদন ক্ষমতা (productivity) তুলনামূলকভাবে বেশী। তাই ভূমি সংস্কারের ফলে উৎপাদন বাড়ে, কৃষিপণ্যের দাম কমে ফলে মজুরীও কমে যা শ্রমঘন শিল্পের সহায়ক।
বিভিন্ন বিতর্ক সত্ত্বেও আজ বিশ্বব্যাংকও এক রকম ভূমি সংস্কারের কথা বলছে, আর তা হচ্ছে উপরোল্লিখিত বাজারভিত্তিক সংস্কার। আমরা যদি বাংলাদেশকে একটি ঝরঝরে তাজা অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চাই তবে ভূমি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। রপ্তানীমুখী শিল্পের গুনগান করতে গিয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই যে আজকের দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের পিছনের ইতিহাস হচ্ছে প্রত্যক্ষ ভূমি সংস্কার থেকে জন্ম নেয়া কৃষি বিপ্লব। সরকার তার ইশতেহার বাস্তবায়নে দ্রুত প্রতিশ্রুত ভূমি সংস্কার কমিশন গঠন করে আমাদের কে স্বপ্নময় গন্তব্যে পৌঁছে দেবে সে অপেক্ষায় বাংলাদেশ!
নাজমুস সাকিব
(দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে সম্পাদকীয় হিসেবে পূর্ব প্রকাশিত)
সুন্দর লিখেছেন ভাইয়া।
উত্তরমুছুনঅর্ক, ১ম বর্ষ, অর্থনীতি, ঢাবি
souvik.arko@econdu.ac.bd