শনিবার, ১২ জুন, ২০১০

কোন পথে সংকট পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিঃ সংশোধিত পুঁজিবাদ?


যে মন্দা সারা পৃথিবীকে একইসাথে সংকটে নিক্ষেপ করেছে সে মন্দা কি ভাল কিছু দিয়ে গেল? অনেকের ভাষায় এই মন্দা এক নয়া ধনতন্ত্রের (New Capitalism) দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে খোদ পুঁজিবাদের বোদ্ধাদেরই বাধ্য করেছে। এই নতুন ধনতন্ত্রও একপ্রকার ধনতন্ত্র হওয়ার কারণে ধনতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ঠ্য যেমন বাজারের উপস্থিতি, মুনাফা আকাঙ্ক্ষা (profit motive), ব্যক্তিগত লাভের প্রণোদনা এগুলো অবশ্যই উপস্থিত থাকবে। তাহলে আমাদের আলোচ্য নয়া ধনতন্ত্র পুরোনো ধনতন্ত্র থেকে কী কী দিক থেকে পৃথক?
আমাদের একথা মেনে নিতেই হবে কোন অর্থনীতিতে বাজারের উপস্থিতিই তাকে ধনতন্ত্রে পরিণত করেনা। আমরা নেতি অর্থে যে পুঁজিবাদকে চিনি তার মূল গলদটা বাজারের উপর চাপিয়ে দেয়া মোটেই উচিত নয়। বাজারের অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করে সকল ভোগ্যবস্তু কতটা লাগবে এবং কী পরিমাণে লাগবে তা কেন্দ্রীয়ভাবে ঠিক করে ফেলার কাজটা মোটেই সহজ নয়। এক্ষেত্রে বাজারদর দারুন এক সিগন্যাল এর কাজ করেছে। বাজার নিজেই চাহিদা যোগানের সাম্যাবস্থা থেকে ঠিক করে নিতে পারে কোন জিনিস কী পরিমাণ উৎপাদিত হবে। কিন্তু বাজার যেখানে একাজটা ঠিকভাবে করেনা সেখানেই যত বিপত্তির শুরু।
বাজারের একটি জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে টাকা-ভোট (dollar-vote)। যার যত টাকা তার তত ভোট। এবার পণ্য সামগ্রীগুলোকে যদি ভোটপ্রার্থীর মত ধরে নেয়া হয় তবে যে পণ্যের পেছনে যত টাকা খরচ হবে সেই পণ্য ততবেশী উৎপাদিত হবে। লাগামহীন(unfettered)বাজার ব্যবস্থায় আদতে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে। এর ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রিধাকারের বিকৃত (distorted priority) ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ধনী ব্যাক্তিরা বিলাসিতা ও অপচয় বাবদ বিরাট অর্থ খরচ করেছে। বাজার তার মূলনীতি অনুযায়ী সে কাজে সহায়তা দিয়েছে। অন্যদিকে প্রচুর প্রকৃত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পকেটে টাকা-ভোট দেবার মত টাকা না থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়না, ফলে দাম থেকে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে এই লাগামহীন বাজারে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্যের মত ঘটতে দেখা যাচ্ছে যে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য যেমন শিশু খাদ্য যতটুকু উৎপাদিত হবার দরকার ছিল তার চেয়ে কম উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে যোগান স্বল্পতার থেকে সৃষ্ট উচ্চমূল্য স্বল্প আয়ের মানুষদের কে নিরব দূর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নয়া ধনতন্ত্রকে অবশ্যই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism) যা অর্থনৈতিক চিন্তার একটি দিকপাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেটি পুনরায় বিবেচিত হতেই হবে। সামাজিক ডারউইনবাদ বলছে survival for the fittest এই তত্ত্ব অর্থনীতিতেও মোড়লীপনা করবে। এর অর্থ দাঁড়িয়ে গেল এই যে যেসব মানুষ পঙ্গু/অক্ষম বা শোষিত-সর্বশান্ত তার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কিছুই করার নেই। যেহেতু তার ক্ষমতা নেই তাই সে টিকতে পারবেনা। এখানে রাষ্ট্রের কি করার আছে? কিন্তু মানুষ যদি একটি সামাজিক জীব হিসেবে বিবেচিত হয়ই তাহলে খুব কম করে বললেও এমন চিন্তা সম্পর্কে এটুকুই বলা যায় যে এটি একটি অসামাজিক নীতি।
নিঃশর্ত পুঁজিবাদের ধারক বাহকেরা সমাজতন্ত্রাভিমুখি স্রোত রোধ করার জন্যই হোক আর অন্য কোন সুপ্ত কারণেই হোক কল্যাণ রাষ্ট্রের যে নতুন ধারণা চালু করতে চেয়েছেন তা রাষ্ট্রকে একটি ভারবাহী বলদে পরিণত করেছে মাত্র। ঘাটতি বাজেট টানতে টানতে আজ দেশগুলো ক্লান্ত। কোন যুক্তি দিয়েই বোঝা যাচ্ছেনা সক্ষম বেকারের ভার কেন সরকার টানবে। একই সাথে একথাও প্রশ্নাকারে উত্থাপিত হচ্ছে যে অত্যন্ত ধনী এবং নিতান্ত হতদরিদ্র সকলকে একই ধরনের স্বাস্থসেবার আওতায় নিয়ে আসার চেয়ে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা কি নেই?
পুঁজিবাদের আরেকটি বড় ধরনের মৌলিক চিন্তার উপাদান হচ্ছে অ্যাডাম স্মিথ এর অদৃশ্য হাতের (invisible hand) ধারণা। এর মূল কথা সহজ ভাষায় হচ্ছে এমন যে, যদি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের উন্নতির জন্য চেষ্টা করে তবে নিজেদের উন্নতি করার চেষ্টার মাধ্যমেই একটি অদৃশ্য হাত পুরো সমাজের উন্নতি করবে। কিন্তু এই মূলনীতির একটি মৌলিক সমালোচনা হচ্ছে এই যে, যা একজনের জন্য ভাল তা সামগ্রিক ভাবে সবার জন্য ভাল নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরুপ স্টেডিয়ামে খেলা দেখার সময় বসে থাকা একজন দর্শক উঠে দাঁড়ালে হয়ত ভাল খেলা দেখতে পায়। কিন্তু যদি সবাই উঠে দাঁড়ায় তবে কেমন হবে? তাই দেখা যায় ব্যক্তির জন্য কল্যাণজনক হওয়া সত্ত্বেও একটি নীতি সমাজের জন্য অকল্যানজনক হতেই পারে।
এসব তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক সমালোচনা এবং অবশ্যই মহাসংকট পুঁজিবাদের মহাবোদ্ধাদেরকেও আগের মত আর এই বুলি কপচাতে দিচ্ছেনা যে “that government is best which is least”। এর প্রমাণই আমরা দেখছি পশ্চিমা দেশগুলোর রেসকিউ বা বেইল আঊট এর ছদ্মাবরণে নেয়া রাষ্ট্রীয়করণের হিরিকে। কিন্তু এরকম গোঁজামিল দিয়েই বা কতদিন আর কেনই বা প্রত্যেকবার নৌকা ডুবে যাবার পর উদ্ধার প্রচেষ্টা? নৌকা ডোবার আগে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়না? সে প্রশ্নের উত্তর খঁজতে হলে পুঁজিবাদের মূল ভিত্তি (assumption) গুলো আবার খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তবে একথা সুনিশ্চিত যে এই খুঁড়িয়ে চলা পুঁজিবাদ আর নয়। বিকল্পটা আসলে কী তা কিছুটা আন্দাজ করা গেলেও এখনও সুস্পষ্ট নয়।
নাজমুস সাকিব
("দৈনিক আমাদের অর্থনীতি"র সম্পাদকীয় হিসেবে পূর্বপ্রকাশিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন