শনিবার, ২৬ জুন, ২০১০

Economics, Psychology and Philosophy :: The world’s most assaulting weapons



by Muhammad Ohiul Islam

It appears that Economics, Psychology and Philosophy are the world’s most assaulting weapons. Let us see how they fall in weapon class apart from classrooms. Let us take Economics. WB and IMF are two potent institutions who hold the leverage of decision-making on every government that has been held captive in virtual prison of debt. The timid arguments of the third world governments and demonized demonstrations in South America against PRSP note the symphony of plague that allocates the so-called vicious circle of poverty. Economics is the weapon, to be precise, manipulation of economic analysis and forecasting of national development is the mechanism of Economics Hit man’s noble operation. The traces of such manipulation are not invisible in the elegant theories in economics texts. There is a gorge beyond the sight of pleading eyes looking up at godlike WB and IMF, etc. between what is learnt in class rooms and what happens in reality and deep down holds the plight of the poor concealed. We cannot render the compound interest earning by “Bankers to the poor” simply null and void that leaves a boulder of assortment of debt services on choking indigents’ throats. Their howls and cries would not budge our eardrums if we were not made of the moral courage, innate in our very souls, handed down by our ancestors who were dogmatic in question of righteousness. Our values can mend our loopholes. We shall not leave “us” in the devil’s grip. “Back to the origin” that is a bass synchronized with the modern world’s perspectives. (Ahem! A slight digression; don’t mind at all)

Therefore economics renders as a tool for exploitations. Don’t look up for your savior folks; look out for your own hammers and blades.

A sick fabrication of psychoanalysis is that “freedom fighting” is held irrational. One vilifying reason the thin tanks put forward is the mentally disturbed population under dictatorial exploitation are trigger happy, worth murdering. They are at ease on declaring the war of sanity against the insane. This is the manipulation of psychoanalysis that disproves the attempts to win back our freedom.

Philosophy is the one last weapon I’m going to talk about. What makes them go beyond the border of conscience is the new concept of conscience that has a wider purview of unethical activities allowed. The pale and osseous hand of desecration of morality is clutching the throat of the angel of goodness in their minds. We see some ruthless dogmas of atheism, antitheism, neo-paganism, in one way or another validates the ill will of evil brains. The breakdown of family and society is getting faster and emerging as the most vicious troll ever born. Breakdown proves desecration of all familial and societal structures. The selfishness will get them nowhere. But we fail to understand because of fiendish ones plotted in the most astute ways.

They understand what they are given to understand; they do not look beyond, they just look within. We serve what they want us to serve. They keep faith in the New World Order; because they survived and won wars and trashed everyone else.

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০১০

Can Agrarian Reform lead to a Pro-Poor Growth? Implications for Bangladesh


Abstract
In recent times, though the growth has increased by quite a rapid rate the situation of
poverty is worsening. The growth cannot resolve the problems of poverty and inequality;
thus, new thinking about Pro-Poor Growth arises. It is found that agrarian reform in many countries like South Korea or Taiwan paved a way towards sustainable development while reduced inequality in Cuba. This paper studies the feasibility of agrarian reform and the advantages that can be gained by Bangladesh from the evidences of successful agrarian reform. A simple representation is build up here which shows the gradual advancement towards Pro-Poor Growth led by agrarian reform through faster agricultural growth. Some suggestions are put forward in the end.

Download [pdf]

সোমবার, ১৪ জুন, ২০১০

যা করলে বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ান হতে পারবে


দ্বৈত অর্থনীতির চিন্তা থেকে শুরু। ছয় দফার হাত ধরে গুটি গুটি পা ফেলে স্বাধীকারের দিকে ছুটে চলা। বিজয় এসেছে একরাশ স্বপ্ন আর নতুন দিনের বার্তা নিয়ে। অর্থনৈতিক শোষণই এ স্বাধীনতাকে যৌক্তিক পরিণতির স্বাদ এনে দিয়েছে।কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির দেখা পাওয়া বরাবরই সূদুর পরাহত রয়ে গেল। প্রায় চার দশক পর আজকের বাংলাদেশে নিজেকে যখন এ প্রশ্নের মুখোমুখী করি “কি নেই যার জন্য আমরা পারলাম না?” তখন চোখের সামনে সব কিছু ছাপিয়ে ভেসে ওঠে আমাদের অর্থনীতির কিছু গঠনগত (structural) সমস্যা।
শিল্প আমাদের করতেই হবে। যারা একদিন আমাদের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল এবং শিল্প করে এখন সেবাখাতের দিকে এগোচ্ছে তারা কিভাবে করেছে? অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর রেসিপিটা হচ্ছে আগে কৃষি বিপ্লব তার পিছে পিছে শিল্প বিপ্লব এবং তারপর সেবা খাতের বিকাশ। আমাদের দেশে কৃষির বিপ্লবটা দেখার আগেই যখন একধাপ ডিঙ্গিয়ে সেবা খাতের বিকাশ শুরু হল তখনও শিল্প শৈশবে হামাগুঁড়ি দিচ্ছে। এই প্যাটার্নটা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত বৈষম্যকেই নাঙ্গা করে তুলে ধরছে। ধরা যাক, আজকের শিল্পন্নোত দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের কথা। তাদের আজকের শিল্পন্নোত অবস্থার পেছনে রয়েছে অভূতপূর্ব কৃষিবিপ্লব।
আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনের স্লথ গতি এবং তদসংশ্লিষ্ট ব্যাপক উৎপাদন উপকরণের (প্রধানত ভূমি) বৈষম্য অব্যাহত রেখেই শিল্পের দিকে রওনা করা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল নয়। সংবিধানে বর্ণিত সামাজিক সুবিচারের প্রশ্ন ছাড়াই শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির খাতিরেই আমাদের যে কাজটি করতেই হবে তা হচ্ছে ভূমি ও কৃষি সংস্কার। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সপ্তম অনুচ্ছেদের চতুর্থ পয়েন্টে মূলত এই বাস্তবতাকেই অক্ষরে অক্ষরে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
ভূমি ও কৃষি সংস্কার কিভাবে হতে পারে সেটি নিসঃন্দেহে একটি ব্যপক বিতর্ক সাপেক্ষ বিষয়। নতুন কোন বিতর্কের উদ্ভব না ঘটিয়েই বলতে চাই বাজার বা মূল্য ব্যবস্থা (price mechanism) ভিত্তিক ভূমি সংস্কার এখন আর কোন কল্পিত বিষয় নয়। অনুপস্থিত ভূমিমালিকানার পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যে বহু লোকই পাওয়া যাবে এমন যাদের জন্য কোন উন্নততর সুযোগ বা প্রণোদনা সৃষ্টি সম্ভব হলে তারা সহজেই জমি বেচতে চাইবে। সরকারের পয়লা কাজ হওয়া উচিত এই সব অনুপস্থিত ভূমিমালিকদের জমি এক্ত্র করে “ভূমি ব্যাংক” তৈরি করা।
সরকারের মোট খাস জমির কোন পরিসংখ্যান পাওয়া দুস্কর হলেও ডঃ আবুল বারকাতের অনুমান হচ্ছে ৫ লক্ষ একর। এই সব বেহাত হওয়া অথবা পতিত বেকার পড়ে থাকা জমি যদি যোগ দেয়া হয় “ভূমি ব্যাংক” এ তবে পরিমাণটা বেশ বড়ই হবে। এবার আসা যাক বিতর্কের কেন্দ্রস্থল ভূমির উর্ধ্বসীমা (ceiling) প্রসঙ্গে। অবশ্যই বর্তমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভূমির উর্ধ্বসীমা আরো কমিয়ে আনার দাবি রাখে কিন্তু বিপুল ম্যান্ডেট ধারী এ সরকার যদি বর্তমান উর্ধ্বসীমাই বাস্তবায়নে সক্ষম হয় এবং তা যুক্ত হয় “ভূমি ব্যাংক” এ তবে নিঃসন্দেহে বিপুল পরিমাণ জমি পাওয়া যাবে। বন্টনের ক্ষেত্রে এই সব জমি দেয়া উচিত সেই সব কৃষককে যাদের কিছুটা জমি আছে (গবেষণায় প্রাপ্ত পরিমাণ ১.৫ একরের বেশী)। একদম ভূমিহীন কৃষককে জমি দেবার সম্ভাব্য পরিণতি হচ্ছে জমি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যে পারি জমানো।সরকার “ভূমি বন্ড” ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদে জমির দাম বিক্রেতাকে পরিশোধ করতে পারে। যারা নির্দিষ্ট হারে খাজনা পেয়ে অভ্যস্থ তারা এতে খুশি হওয়া উচিত অন্তত এটা ভেবে যে, বর্গাচাষীদের কাছ থেকে খাজনা পাওয়ার অনিশ্চয়তা এখানে নেই। অন্যদিকে সরকার অর্থ সংস্থান করতে পারে কৃষকদের দেয়া জমির ব্যাপারে চুক্তি ভিত্তিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে অথবা শিল্প করতে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া জমির দাম থেকে।

এভাবে জমির পরোক্ষ পুনর্বন্টন প্রকৃতিগতভাবেই সমতাভিমুখী হওয়ায় একটি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি (sustainable growth) অর্জনে খুবই সহায়ক। এতে একদিকে বর্গাচাষীদের এক বিরাট অংশ একপ্রকার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে,যা তাদেরকে শ্রম বিক্রি করতে উদ্বুদ্ধ করবে; অন্যদিকে এই উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিই কৃষি বিপ্লবের সম্পূরক হিসেবে একটি শ্রমঘন পল্লী শিল্পায়নের চালিকা শক্তিতে পরিণত হবে।এখন এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে ক্ষুদ্র মালিকদের উৎপাদন ক্ষমতা (productivity) তুলনামূলকভাবে বেশী। তাই ভূমি সংস্কারের ফলে উৎপাদন বাড়ে, কৃষিপণ্যের দাম কমে ফলে মজুরীও কমে যা শ্রমঘন শিল্পের সহায়ক।
বিভিন্ন বিতর্ক সত্ত্বেও আজ বিশ্বব্যাংকও এক রকম ভূমি সংস্কারের কথা বলছে, আর তা হচ্ছে উপরোল্লিখিত বাজারভিত্তিক সংস্কার। আমরা যদি বাংলাদেশকে একটি ঝরঝরে তাজা অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চাই তবে ভূমি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। রপ্তানীমুখী শিল্পের গুনগান করতে গিয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই যে আজকের দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের পিছনের ইতিহাস হচ্ছে প্রত্যক্ষ ভূমি সংস্কার থেকে জন্ম নেয়া কৃষি বিপ্লব। সরকার তার ইশতেহার বাস্তবায়নে দ্রুত প্রতিশ্রুত ভূমি সংস্কার কমিশন গঠন করে আমাদের কে স্বপ্নময় গন্তব্যে পৌঁছে দেবে সে অপেক্ষায় বাংলাদেশ!
নাজমুস সাকিব
(দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে সম্পাদকীয় হিসেবে পূর্ব প্রকাশিত)

শনিবার, ১২ জুন, ২০১০

কোন পথে সংকট পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিঃ সংশোধিত পুঁজিবাদ?


যে মন্দা সারা পৃথিবীকে একইসাথে সংকটে নিক্ষেপ করেছে সে মন্দা কি ভাল কিছু দিয়ে গেল? অনেকের ভাষায় এই মন্দা এক নয়া ধনতন্ত্রের (New Capitalism) দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে খোদ পুঁজিবাদের বোদ্ধাদেরই বাধ্য করেছে। এই নতুন ধনতন্ত্রও একপ্রকার ধনতন্ত্র হওয়ার কারণে ধনতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ঠ্য যেমন বাজারের উপস্থিতি, মুনাফা আকাঙ্ক্ষা (profit motive), ব্যক্তিগত লাভের প্রণোদনা এগুলো অবশ্যই উপস্থিত থাকবে। তাহলে আমাদের আলোচ্য নয়া ধনতন্ত্র পুরোনো ধনতন্ত্র থেকে কী কী দিক থেকে পৃথক?
আমাদের একথা মেনে নিতেই হবে কোন অর্থনীতিতে বাজারের উপস্থিতিই তাকে ধনতন্ত্রে পরিণত করেনা। আমরা নেতি অর্থে যে পুঁজিবাদকে চিনি তার মূল গলদটা বাজারের উপর চাপিয়ে দেয়া মোটেই উচিত নয়। বাজারের অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করে সকল ভোগ্যবস্তু কতটা লাগবে এবং কী পরিমাণে লাগবে তা কেন্দ্রীয়ভাবে ঠিক করে ফেলার কাজটা মোটেই সহজ নয়। এক্ষেত্রে বাজারদর দারুন এক সিগন্যাল এর কাজ করেছে। বাজার নিজেই চাহিদা যোগানের সাম্যাবস্থা থেকে ঠিক করে নিতে পারে কোন জিনিস কী পরিমাণ উৎপাদিত হবে। কিন্তু বাজার যেখানে একাজটা ঠিকভাবে করেনা সেখানেই যত বিপত্তির শুরু।
বাজারের একটি জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে টাকা-ভোট (dollar-vote)। যার যত টাকা তার তত ভোট। এবার পণ্য সামগ্রীগুলোকে যদি ভোটপ্রার্থীর মত ধরে নেয়া হয় তবে যে পণ্যের পেছনে যত টাকা খরচ হবে সেই পণ্য ততবেশী উৎপাদিত হবে। লাগামহীন(unfettered)বাজার ব্যবস্থায় আদতে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছে। এর ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রিধাকারের বিকৃত (distorted priority) ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ধনী ব্যাক্তিরা বিলাসিতা ও অপচয় বাবদ বিরাট অর্থ খরচ করেছে। বাজার তার মূলনীতি অনুযায়ী সে কাজে সহায়তা দিয়েছে। অন্যদিকে প্রচুর প্রকৃত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পকেটে টাকা-ভোট দেবার মত টাকা না থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়না, ফলে দাম থেকে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে এই লাগামহীন বাজারে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্যের মত ঘটতে দেখা যাচ্ছে যে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য যেমন শিশু খাদ্য যতটুকু উৎপাদিত হবার দরকার ছিল তার চেয়ে কম উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে যোগান স্বল্পতার থেকে সৃষ্ট উচ্চমূল্য স্বল্প আয়ের মানুষদের কে নিরব দূর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নয়া ধনতন্ত্রকে অবশ্যই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism) যা অর্থনৈতিক চিন্তার একটি দিকপাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেটি পুনরায় বিবেচিত হতেই হবে। সামাজিক ডারউইনবাদ বলছে survival for the fittest এই তত্ত্ব অর্থনীতিতেও মোড়লীপনা করবে। এর অর্থ দাঁড়িয়ে গেল এই যে যেসব মানুষ পঙ্গু/অক্ষম বা শোষিত-সর্বশান্ত তার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কিছুই করার নেই। যেহেতু তার ক্ষমতা নেই তাই সে টিকতে পারবেনা। এখানে রাষ্ট্রের কি করার আছে? কিন্তু মানুষ যদি একটি সামাজিক জীব হিসেবে বিবেচিত হয়ই তাহলে খুব কম করে বললেও এমন চিন্তা সম্পর্কে এটুকুই বলা যায় যে এটি একটি অসামাজিক নীতি।
নিঃশর্ত পুঁজিবাদের ধারক বাহকেরা সমাজতন্ত্রাভিমুখি স্রোত রোধ করার জন্যই হোক আর অন্য কোন সুপ্ত কারণেই হোক কল্যাণ রাষ্ট্রের যে নতুন ধারণা চালু করতে চেয়েছেন তা রাষ্ট্রকে একটি ভারবাহী বলদে পরিণত করেছে মাত্র। ঘাটতি বাজেট টানতে টানতে আজ দেশগুলো ক্লান্ত। কোন যুক্তি দিয়েই বোঝা যাচ্ছেনা সক্ষম বেকারের ভার কেন সরকার টানবে। একই সাথে একথাও প্রশ্নাকারে উত্থাপিত হচ্ছে যে অত্যন্ত ধনী এবং নিতান্ত হতদরিদ্র সকলকে একই ধরনের স্বাস্থসেবার আওতায় নিয়ে আসার চেয়ে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা কি নেই?
পুঁজিবাদের আরেকটি বড় ধরনের মৌলিক চিন্তার উপাদান হচ্ছে অ্যাডাম স্মিথ এর অদৃশ্য হাতের (invisible hand) ধারণা। এর মূল কথা সহজ ভাষায় হচ্ছে এমন যে, যদি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের উন্নতির জন্য চেষ্টা করে তবে নিজেদের উন্নতি করার চেষ্টার মাধ্যমেই একটি অদৃশ্য হাত পুরো সমাজের উন্নতি করবে। কিন্তু এই মূলনীতির একটি মৌলিক সমালোচনা হচ্ছে এই যে, যা একজনের জন্য ভাল তা সামগ্রিক ভাবে সবার জন্য ভাল নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরুপ স্টেডিয়ামে খেলা দেখার সময় বসে থাকা একজন দর্শক উঠে দাঁড়ালে হয়ত ভাল খেলা দেখতে পায়। কিন্তু যদি সবাই উঠে দাঁড়ায় তবে কেমন হবে? তাই দেখা যায় ব্যক্তির জন্য কল্যাণজনক হওয়া সত্ত্বেও একটি নীতি সমাজের জন্য অকল্যানজনক হতেই পারে।
এসব তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক সমালোচনা এবং অবশ্যই মহাসংকট পুঁজিবাদের মহাবোদ্ধাদেরকেও আগের মত আর এই বুলি কপচাতে দিচ্ছেনা যে “that government is best which is least”। এর প্রমাণই আমরা দেখছি পশ্চিমা দেশগুলোর রেসকিউ বা বেইল আঊট এর ছদ্মাবরণে নেয়া রাষ্ট্রীয়করণের হিরিকে। কিন্তু এরকম গোঁজামিল দিয়েই বা কতদিন আর কেনই বা প্রত্যেকবার নৌকা ডুবে যাবার পর উদ্ধার প্রচেষ্টা? নৌকা ডোবার আগে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়না? সে প্রশ্নের উত্তর খঁজতে হলে পুঁজিবাদের মূল ভিত্তি (assumption) গুলো আবার খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তবে একথা সুনিশ্চিত যে এই খুঁড়িয়ে চলা পুঁজিবাদ আর নয়। বিকল্পটা আসলে কী তা কিছুটা আন্দাজ করা গেলেও এখনও সুস্পষ্ট নয়।
নাজমুস সাকিব
("দৈনিক আমাদের অর্থনীতি"র সম্পাদকীয় হিসেবে পূর্বপ্রকাশিত)

সোমবার, ৭ জুন, ২০১০

পিপিপিঃ কল্যাণ রাষ্ট্রের সেবাখাত চলে যাচ্ছে বেসরকারীখাতে!


নাজমুস সাকিব

সহজ পাঠ
পিপিপি হচ্ছে দুই পক্ষের সম্মিলিত এক কারবার। একপক্ষ সরকার এবং অন্য পক্ষ এক বা একাধিক বেসরকারী পুঁজি লগ্নিকারী। ধরে নেয়া হয় যে, প্রত্যেক পক্ষ অপর পক্ষের চেয়ে নিজ ভূমিকা পালনে বেশী দক্ষ ও কার্যকর। সরকারী খাতের তুলনামূলক সুবিধাগুলো হচ্ছে, এটি ভাল তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া মান নির্ধারণ, প্রস্তাবনা তৈরী,চুক্তি সম্পাদন, সময় নিয়ন্ত্রণ, পারফরমেন্সের লক্ষ নির্ধারণ,শর্তারোপ, ফান্ড সরবরাহ, রিক্রুটিং, মূল্য নির্ধারণ, এধরণের কাজের জন্য সরকারী খাত অপরিহার্য। অপরদিকে প্রাইভেট সেক্টর কাজ শুরুর পরে আসল কাজগুলো করে।
এখানে সরকারের দিক থেকে যে সংস্থাগুলো জড়িত তা হচ্ছে- কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা প্রশাসন, মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য সংস্থাসমূহ, সরকারী কর্পোরেশনগুলো, সরকারী হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। আর বেসরকারী পক্ষগুলো হচ্ছে- বানিজ্যিক লাভজনক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবি সঙ্ঘ, কমিউনিটি ভিত্তিক সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অতিঅবশ্যই পরিবার। সাধারণত সরকারী খাতের কিছু সীমাবদ্ধতা যেমন পুঁজি বা দক্ষ জনবলের অভাবের কারণে এই পার্টনারশীপের কথা চিন্তা করা হয়। কিছু কিছু পিপিপি শুধুমাত্র যারা সেবা লাভ করে তাদের কাছ থেকে অর্থায়ন করা হয় যেমন টোল বা স্পেশাল ভ্যাট আদায়; আর অন্য পিপিপিগুলো সাধারণ ট্যাক্সের টাকায় অর্থায়ন করা হয়।
সাধারণত প্রাইভেট কম্পানীগুলোর একটি দল মিলে তৈরী করে Special Purpose Vehicle (SPV) । এই এসপিভি প্রজেক্টের ব্যবহারের জন্য সম্পদ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং পরিচালনা করে। এসপিভিই সরকারের সাথে এবং সাবকন্ট্রাক্টরদের সাথে কাজ পরিচালনার জন্য চুক্তি করে এবং পুরো কাজ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধান করে।
এতো গেল পিপিপি কিভাবে চলে তার কথা। কিন্তু পিপিপি করার প্রয়োজন পড়ল কেন? অনেকেই মনে করেন পিপিপি হচ্ছে স্রেফ সুন্দর পোষাক পরিহিত বেসরকারীকরণ। সোজাসাপ্টাভাবে সরকারী জিনিসপত্র বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেবার কথা মুখে বলতে যাদের শরমিন্দা, আবার সরকারের আকার ছোট করতেও যাদেরকে অমোঘ আকর্ষন টেনে নিয়ে যায়, তাদের জন্য পিপিপির চেয়ে আশীর্বাদময় কোন কিছুই হতে পারেনা। যেহেতু কম্পানির কাজ হচ্ছে মুনাফা কিভাবে বাড়ানো যায় সে চিন্তা করা সুতরাং সে অতিরিক্ত লাভ না পেলে কাজ হাতে নেবেনা।আর যদি সে পিপিপিতে মুনাফা করতে সক্ষম হয় তবে এই মুনাফার টাকাটা আসবে জনগণের পকেট থেকে। এটাই হচ্ছে সেই লোভনীয় কারণ যার জন্য “প্রফিট ম্যাক্সিমাইজিং ফার্ম” জনসেবায় আসতে চায়।

গোড়ার কথা
পিপিপি একেক দেশে একেক চরিত্রে একেক নামে চলেছে। উইকিপিডিয়া বলছে প্রথম এটা ১৯৯২ সালে ইউকে তে চালু হয়েছিল। তখন অবশ্য এর নামটা ছিল পিএফআই- প্রাইভেট ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভ। পাবলিক সেক্টরের ঋণের বোঝা কমানোই এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এরপর আমেরিকাসহ অনেক দেশেই অনেক নামে এটা চলেছে। ইন্ডিয়ায় বছর দশেক হল এই প্রজেক্ট বেশ দাপটের সাথে এগিয়ে চলছে। সিঙ্গাপুরে “ভ্যালু ফর মানি” এই হিসেবে পিপিপি চলছে। দক্ষিন কোরিয়ায় প্রথম দিকে অবকাঠামো তথা রাস্তাঘাট করা দিয়ে শুরু হলেও যেসব সেবাখাত পুঁজিপতিদের নাগালের বাইরে ছিল সেগুলোই বেসরকারীখাতের করায়ত্ত হয়েছে। মালোশিয়ার অবস্থাটা একটু ব্যতিক্রম, এখানে রাজনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক মটিভেশন পিপিপিতে একটা বড় ভুমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া নিউজিল্যান্ডের রয়েছে এবিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা। খোদ ব্রিটেনেও পিপিপির অনেক প্রকল্প শুরু করে হোঁচট খেয়েছে। মোটা দাগে বিশ্বব্যাপী পিপিপিকে দেখে কোন এক-কথার মন্তব্য করতে হলে এটুকুই বলা যায় যে বেসরকারীকরণের সাথে এর পার্থক্যটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন।

বাংলাদেশে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটেই প্রথম পিপিপির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সরকারী সংস্থা ও কর্পোরেশনের বেসরকারী করণের নানান প্রক্রিয়ার শুরু আরো অনেক আগেই। বাজেটেরঅবস্থানপত্রে পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলোকে ৩ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: জনগুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ প্রকল্প, জনগুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য প্রকল্প এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের প্রকল্প। অবস্থান পত্রে বলা হয়েছে, এই জনগুরুত্ব বিশাল প্রকল্পগুলো ৫-৭ বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে:

ঢাকা চট্টগ্রাম একসেস কন্ট্রোল হাইওয়ে (২২ হাজার ১০০ কোটি ৭০ লাখ টাকা), ঢাকা শহরের চারপাশে স্কাই রেল(১৯ হাজার ৩২০ কোটি টাকা), ঢাকা শহরে পাতালরেল ( ৮ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা),৪ টি ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা-ভিত্তিক অথবা ডিজেল ও গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র (১২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা)ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর-ঢাকা এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে ( ১৩ হাজার ১১০ কোটি টাকা), এবং গভীর সমুদ্র বন্দর (অপ্রাক্কলিত)।

পেছনের যুক্তিগুলো
সবচেয়ে বেশী যে যুক্তিটি পিপিপির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে সরকারের মূলধন সংকট ও তদসংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত দূর্বলতা। সাধারণ ধারণা হচ্ছে বেসরকারী খাত সরকারী খাতের চেয়ে বেশী দক্ষ। সরকারী খাতের দূর্নীতির বিপরীতে বেসরকারী খাতে অধিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় এধারণাটিও পিপিপির পক্ষে জোরালো এক যুক্তি। পিপিপিতে দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার দ্বারা প্রজেক্টের খরচ কমে আসে এমন কথাও প্রায়ই শোনা যায়। টেকনোলজির ক্ষেত্রে পিপিপির বিশেষ কি উপকারীতা তা যদিও বোধগম্য নয়, কিন্তু সকল এ্যাকাডেমিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রেই টেকনোলজিকে পিপিপি থেকে প্রাপ্ত এক বিশেষ সুবিধা হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে পিপিপির ফলে উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির সুযোগ পায় যা দেশের মোট উন্নয়নে ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে প্রাইভেট সেক্টরের বিশেষায়িত সেবা পাবলিক সেক্টরের লোকেরা পেতে পারে। এছাড়া ঝুঁকি বহনের ক্ষেত্রে বলা হয় যে ঝুঁকি বহনের সবচেয়ে যোগ্য লোকেরাই এটা সামলানোর কাজ পায়। কাজ যথাসময়ে শেষ করার নিশ্চয়তা পিপিপির একটি বড় সুবিধা।
বাস্তব সমস্যা
এতক্ষন পিপিপির ব্যাপারে যেসব সুবিধার কথা বলা হল তা প্রায় সবই হচ্ছে বইয়ের ভাষার কথা। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিপিপির কিছু সমস্যা রয়েছে। সরকারের সবচেয়ে বড় যে সীমাবদ্ধতার জন্য পিপিপির দিকে আসা তা হচ্ছে মূলধন স্বল্পতা। বলা হয় বেসরকারী খাত হাজার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে সহজেই টাকা নিয়ে এগিয়ে আসবে। আরেক দিকে দেশের ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত্ব তারল্যের পরিমাণ দিনকে দিন বাড়ছে।পত্রিকাগুলোতে এই উদ্বৃত্ত্ব তারল্য কিভাবে বিনিয়োগযোগ্য করা যায় সে ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের হাউকাউয়ের কোন কমতি নেই। তাহলে এই টাকা সরকারের হাতদিয়ে খরচ হলে সমস্যা কোথায়? বলা হচ্ছে বেসরকারী বিশেষায়িত পুঁজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারী খাত তথা জনগন লাভবান হবে যদি পিপিপি বাস্তবায়ন করা হয়। আমাদের কি এই প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই যে, প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বা বিআইআইএফ এর মাধ্যমে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে এই বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগে সমস্যাটা কোথায়?
যদি ধরে নেয়া হয় যে কম্পানী জনসেবা করতে বাজারে আসেনি তবে প্রজেক্টে অবশ্যই মুনাফা নিশ্চিত করে তবেই সে বাজারে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই মুনাফার টাকাটা কোন গৌরী সেন দিচ্ছে? কম্পানীর প্রস্তাবিত ভাড়া/টোল/সার্ভিস চার্জের পরিমাণটা কার্যকর ভাড়ার চেয়ে পার্থক্যটা সরকার ভর্তূকির মাধ্যমে পূরণ করছে। কম রেটে ভাড়া নির্ধারণ করা হলে দক্ষিণ আফ্রিকার শঙ্কাটা জিইয়ে থাকছে। সেখানে কম্পানীগুলো সরকারী ভর্তুকি পেয়ে ১০ লক্ষ ফ্ল্যাট তৈরির পর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে জবাব দিয়েছিলঃ “নিজেদের মুনাফা ধরে রেখে এর চেয়ে উন্নত মানের ফ্ল্যাট তৈরী সম্ভব ছিলনা”।
সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করা হয়েছে পিপিপির ফলে প্রাইভেট সেক্টরের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকার লাভবান হবে। আমাদের অবাক লাগে যে, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সরকার আর কতকাল পরনির্ভরশীল নপুংশক হয়ে থাকবে? তাহলে কেউ কি সরকার কে মানা করেছে আত্ননির্ভরশীল হতে? সরকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে পত্রিকা রিপোর্ট করছে যে, পিপিপি বিভিন্ন সেবা সরবরাহে প্রাইভেট সেক্টরের অংশীদারিত্ব বাড়াবে। নিশ্চয়ই! এবং তার ফলে পাবলিক সেক্টর আরো ছোট হবে।“That government is best which is least” এই স্লোগান বাস্তবায়ন সহজ হবে!
পিপিপির পক্ষের একটি বড় যুক্তি হচ্ছে বেসরকারী খাতে দূর্নীতি নেই তাই এখানে খরচ কম। আসলে বেসরকারী খাতের জন্য বৈধভাবেই অতিরিক্ত লাভ করার ব্যবস্থা আছে। ব্যবসা করতে এসে জনগনের খেদমত করার দায়িত্ব কম্পানির নয়। বলা বাহুল্য কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির (সি.এস.আর) ফান্ড দিয়ে পিপিপি করার চিন্তা বা “দুঃসাহস” মাল মুহিত সাহেব দেখাননি! আর যে দূর্নীতির কথা সব সরকারী কাজের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দেয় তার প্রতিরোধ কি কার্টুন ছবি আঁকা আর বিদেশী টাকায় সেমিনার করে “দূর্নীতি থামাতে হবে এখনই” জাতীয় স্লোগানে পরোক্ষভাবে দূর্নীতির বিজ্ঞাপন দিয়ে সারা পৃথিবীকে জানানো ছাড়া আর কিছুই নয়?
পিপিপিতে প্রাপ্য সেবার ক্ষেত্রে মান কতটুকু বজায় রাখা যাবে সেটি একটি অত্যন্ত বড় চিন্তার কারণ। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে যেটুকু সময় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের দেখাশোনা তথা ভাড়া তোলা জাতীয় কাজে ব্যস্ত থাকবে; তার পর যখন সরকারের কাছে হস্তান্তর করে চলে যাবে সে সময়ের যেকোন ত্রুটির (ধরা যাক, এখন যেমন যমুনা সেতুতে ফাটল দেখা যাচ্ছে) মীমাংশা কিভাবে হবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না করা হলে টেংরাটিলা জাতীয় “দূর্ঘটনা (?)” ঘটলে সরকার দর্শকের ভূমিকা পালন করবে।এছাড়া ঝুঁকি বহনের ক্ষেত্রে যে দূর্ঘটনা এখনো ঘটেনি তবে ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে তার জন্য সরকারকে একটা নির্ধারিত চার্জ দিতে হবে। ব্রিটেনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এসব চার্জ সবসময়ই বেশী করে দেখানো হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে আরো বলা হচ্ছে কাজ সময়মত শেষ করার নিশ্চয়তা পিপিপিতেই পাওয়া যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে যখনই এইসব কম্পানী তাদের এভারেজ ভ্যারিয়েবল কস্ট বা চলতি ব্যায় তুলতে ব্যার্থ হয় তখনই প্রযেক্ট বন্ধ করে; এটাই অর্থনীতির সূত্র। কিন্তু বিপদ এটুকু হলেও কথা ছিল। সাধারণত যেধরনের প্রযেক্ট পিপিপির আওতায় করা হবে তার সবই অতীব জনগুরুত্বপূর্ন কাজ। ফলে সরকার এসব প্রযেক্ট জনপ্রিয়তার ভয়ে বন্ধ করে না। তাই সকল বোঝা এসে পরে ট্যাক্স পেয়ারদের ঘাড়ে। ব্রিটেনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এধরণের প্রকল্পে রেলের কাজে কম্পানীর লোকশানের বোঝা টানতে হয়েছিল স্কুলের কাজে বলি দেবার মাধ্যমে।
কোন প্রকল্পের ব্যায় যদি কাজ চলাকালীন সময়ে বেড়ে যায় তবে তার মাশুল সরকার দিচ্ছে। যে ঋণ নিয়ে কম্পানী কাজ করবে তার সুদ বেড়ে যাওয়ার দায় সরকারের এবং ঋণের গ্যারান্টরও সরকার।কিন্তু সরকার যেহেতু দেউলিয়া হয়না তাই সরকার ঋণ নিলে ঝুঁকি খরচও কম। তাহলে সরকার নিজেই কেন কম খরচে ঋণ নেবেনা?
যদি কম্পানী দেখাতে পারে যে তাদের কস্টের পরিমাণ মোট রেভিনিউয়ের অপেক্ষাকৃত বড় অংশ জুড়ে আছে তবে সেই টাকাটা সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি এবং সেবা ব্যাবহারকারী জনগণের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করার মাধ্যমে উসুল করা যায়। তাই কস্ট বেশী দেখানোর একটা প্রবণতা সবসময়ই লক্ষনীয়। এছাড়া কয়েকটি পক্ষ একত্রিত হয়ে যাচাই বাছাই,পরিকল্পনা, বেসরকারী কম্পানীর উপর সরকারের নজরদারী এসবের কারণে বাস্তবায়ন এবং পরিচালনা খরচ বেড়ে যায়। তাই পিপিপিতে খরচ কম হবার কথাটি একটি স্রেফ বাজে কথা।
পিপিপি হলে জনগন তাথেকে কেমন সার্ভিস পাবে তা দেখা যেতে পারে এখনকার কিছু “আধা-পিপিপি” প্রকল্প থেকে। এখনই কয়েকটি বেসরকারী বিদ্যুত প্রকল্প থেকে সরকার বেশী দামে বিদ্যুত কিনে ভর্তুকী দিয়ে বিদ্যুত সরবরাহ করছে। পিপিপির মাধ্যমে যে বিদ্যুত পাওয়া যাবে তার দাম এর চেয়ে বেশী ছাড়া কম হবেনা। ফলে পিপিপির মাধ্যমে যতধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে তা বিদ্যমান সরকারী আওতাধীন সেবার তুলনায় বেশী দাম দিয়ে কিনতে হবে। ফলে একদিকে জনগণ বেশী ভাড়া দেবে আর অন্যদিকে কম্পানীকে দেয়া ভর্তুকীর টাকাটা আসবে ট্যাক্স থেকে। কি দারুন। পিপিপি কে মনে হচ্ছে এমন তরবারী যার ধার দু’দিকে।
কল্যাণ রাষ্ট্রের সেবাখাত বেসরকারী খাতে!
আওয়ামীলীগের ইশতেহারের ভিশন ২০২১ এ লেখা ছিলঃ “We envision a liberal, progressive and democratic welfare state” welfare state বা কল্যাণ রাষ্ট্র পৃথিবীতে যে কয়টি দেখা যাচ্ছে তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মত সেবা খাতগুলো সরকারের ব্যপক ভর্তুকিতে চলে। একদম ফ্রি সেবার কথা বাদ দিলেও কিভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি এইসব সেবা বিনামূল্যে পাবে তা নিশ্চিত করা কল্যাণ রাষ্ট্রের দ্বায়িত্বের মধ্যে বিবেচিত হয়। আওয়ামীলীগ তো বটেই এর বাইরের সরকার গঠনকারী কোন দলের জন্য ও বাংলাদেশের ইতিহাসে কল্যাণ রাষ্ট্রের ঘোষণা এটাই প্রথম। তাই স্বভাবতই জনগণ আশা করেছিল যে শিক্ষা স্বাস্থ্যের মত সেবা খাতগুলো ধীরে ধীরে আরও সুলভ হবে। কিন্তু আদতে দেখা যাচ্ছে পিপিপির মাধ্যমে এসব খাতও আসলে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ এগুলো আগে বেসরকারী পুঁজিপতিদের নাগালের বাইরে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সমস্যা বা বারডেম এর মত হাসপাতাল পিপিপির আওতায় আসলে এগুলোর খরচ কমবে না বাড়বে তা সহজেই অনুমেয়। প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষাখাত বেসরকারীকরণের ফলাফলাটা কি প্রাইমারী শিক্ষা ব্র্যাকের হাতে ছাড়ার সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের সহিংস প্রতিবাদ থেকে বোঝা যাচ্ছে না?
ডেপুটি কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল মুহাম্মাদ জাকির হোসেন, “Public-Private PartnershipBangladesh Perspective” শীর্ষক এক পেপার প্রেসেন্টেশনে বাংলাদেশের স্বাস্থখাতের বিভিন্ন সমস্য যেমনঃ নূন্যতম মান না থাকা, দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দূর্ব্যবহার তুলে ধরে বললেন এগুলো দূর করতে স্বাস্থ্যখাত পিপিপির আওতায় আনা হলে এটা আরও কার্যকর, গ্রাহক বান্ধব, এবং বেশী ব্যবহৃত হবে। তিনি যে বিষয়টা বললেননা তা হচ্ছে খরচ বেড়ে যাবে বহু বহু গুণ। ঢাকা মেডিক্যালের চেয়ে স্কয়ার বা এ্যাপোলো হাসপাতালের সেবা খুব ভালো এ আর নতুন কী কথা?এই পেপারে আরও বলা হচ্ছে, “The principles of “non-rivalry” and “non-exclusion” of public goods logically point to the criteria of universality and equity in judging the value of partnership” কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পিপিপির ফলে অবশ্যই সরকারী প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিশোধকৃত টোল বা ভাড়ার চেয়ে বেশী টাকা জনগনের পকেট থেকে যাবে। অর্থাৎ আরও বেশি লোক এই সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। যা সঙ্গানুসারেই “পাবলিক গুডস” এর সাথে সাংঘর্ষিক। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি কল্যাণ রাষ্ট্রের সেবাখাত ছেড়ে দেয়া হচ্ছে বেসরকারী খাতে!


শেষ কথা
আমাদের কথা পরিষ্কার, যদি পিপিপির মাধ্যমে বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা বাজারদরের অন্য বেসরকারী বিনিয়োগের চেয়েও বেশি মুনাফা পায় তবে বুঝে নেব এই মুনাফার যোগান দিচ্ছে জনগণ। জনগণের টাকা কিভাবে কম্পানীর মুনাফায় রূপান্তরিত করা যায় সে দায়িত্ব সরকারের নয়। বরং সরকারের দ্বায়িত্ব হচ্ছে জনগণের স্বার্থ দেখা।
একজন উর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা এক সেমিনারে পিপিপির প্রশংসা করে বলেছিলেনঃ“Allowing for the reduction in the size of the public agency and the substitution of private sector resources and personnel”কি আশ্চর্য! সরকারের দায়িত্ব কি বেসরকারী খাতের স্বার্থ রক্ষা করা এবং সরকারী খাত সংকোচন করা? নিজের ভাল নাকি পাগলও বোঝে! খালেদা জিয়ার সরকার ছিল ঘোষিত নয়া উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার সরকার। কিন্তু এবারকার বাম চেহারার ডজনখানেক বিপ্লবী মন্ত্রী এবং একপাল পোষা মস্কো ফেরত অর্থনীতিবিদ সর্বস্ব সিপিডির সরকার এই পলিসি বাস্তবায়ন করছে। আওয়ামীলীগের কাছ থেকে প্রথমে কল্যাণ রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রে সেবা খাতের বেসরকারীকরণ দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে যে রামছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না।
পিপিপির যে দিকটা অনেক সরকারকে উৎসাহ জুগিয়েছে তাহল এর ম্যানেজমেন্ট এর দক্ষতা। এখানে কথা হল ম্যানেজমেন্ট আর মালিকানা দুই জিনিস। ম্যানেজমেন্ট বেসরকারী হাত ঘুরিয়ে যদি ভাল চালানো যায় তবে ক্ষতি কী? কিন্তু আমাদের প্রাণ ও সম্পদের মালিকানা চমৎকারভাবে বেসরকারীকরণ কোন যুক্তিতেই মেনে নেয়া যাবে না।

সূত্রঃ
১। প্রথম আলোঃ ১২ই জুন ২০০৯
২।নিউ এইজঃ ২০ই আগস্ট ২০০৯
৩। Miraftab, 2004. Public-Private Partnerships The Trojan Horse of Neoliberal Development?
৪। Paper presentation: Public-Private Partnership Bangladesh Perspective by Mohammad Zakir Hossain; Deputy Comptroller and Auditor GeneralOffice of the Comptroller and Auditor General of Bangladesh
৫। Wikipedia
৬।দিনমজুর ব্লগ, http://www.somewhereinblog.net/blog/dinmojurblog
৭। বাঙ্গাল ব্লগ, http://www.somewhereinblog.net/blog/troublekid
৮।Paper presentation: Building Public Private Partnership in Bangladesh by Mustafa k. Mujeri.

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত পরিচয়

নাজমুস সাকিব

বাংলাদেশের অর্থনীতির শুরুটা কোথা থেকে করা উচিত তা বলাটা কঠিন। প্রাক ব্রিটিশ সময়ের অবস্থাটা জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ঠিক সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরনের আগের মূহুর্ত, আর মার্কসের ভাষায় স্থবির প্রানহীন এশিয়াটিক মোড অফ প্রডাকশনের যুগ। ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকটা ছিল চরম শোষনের। বাংলা সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল হওয়ায় এখানে শোষনের মাত্রাটা ছিল আরও বেশি। তবে অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধার কারনে আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে শেষের দিকে কিছুটা লাভবানও হয়েছি। পাকিস্তান আমলের শুরুতেই কৃষক-শ্রমিকদের মোহভংগ এবং সেই থেকে দ্বৈত অর্থনীতির চিন্তার শুরু। ক্রমাগত শোষনের ফলে স্বাধীনতার ত্বরান্বিত যাত্রা। এরপরের সরকার গুলোর পারফরমেন্সই মূলত আমাদের এই প্রবন্ধের আলোচ্য। এখানে আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, কৃষিখাত, শিল্প, সেবাখাত, বিদ্যুত, জ্বালানী, আমদানী, রপ্তানী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগ, মুদ্রাস্ফীতি, পুঁজিবাজার, রাজস্ব ব্যাবস্থা, দারিদ্র বিমোচন ও মানব উন্নয়ন।
প্রবৃদ্ধি
প্রবৃদ্ধি হিসাব করার সময় শুধুমাত্র একটা দেশের বিভিন্ন খাতের উৎপাদন কি হারে বাড়ছে তা হিসাব করাই যথেষ্ট নয়। এর সাথে সাথে প্রবৃদ্ধির সুফল কতটা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে তাও হিসাবের আওতায় আনা জরুরী। এটা মাপা হয় আয় বৈষম্য মাপার মাধ্যমে। দারিদ্র বিমোচন ও মানব উন্নয়ন অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রবৃদ্ধি হিসাব করার সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে শতকরা কত হারে এ বছরে সমগ্র অর্থনীতি গত বছরের তুলনায় বেড়ে গেল। চলুন দেখা যাক বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপন (trend) কেমন।
সাল জিডিপি %
১৯৪৯/৫০-১৯৬৯/৭০ ৩.২০
১৯৭২/৭৩-১৯৮১/৮২ ৫.১৩
১৯৮২/৮৩-১৯৮৯/৯০ ৩.৮১
১৯৯৪-১৯৯৫ ৪.৩
১৯৯৬-৯৭ ৫.৪
১৯৯৮-১৯৯৯ ৪.৯
২০০০-২০০১ ৪.৪
২০০৩-০৪ ৬.৩
২০০৫-০৬ ৬.৬
২০০৭-০৮ ৬.১৯
২০০৮-০৯ ৫.৮৮
তথ্য সুত্রঃ ড. মাহাবুব হোসেন ও এ. আর খান (১৯৮৯),মাহবুবুল মোকাদ্দেম (২০০৩), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯

গ্রাফ থেকে যে ট্রেন্ডটা বোঝা যাচ্ছে তা হল সবসময়ই এটা স্বল্পমেয়াদে ওঠা নামা করলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রবনতা উর্ধ্বমুখীই বলতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এটা দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সবসময়ই প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকে। তবে মোটা দাগে প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে বলা যেতে পারে স্বাধীনতা উত্তর প্রবৃদ্ধির হার বেশী থাকার কারণ হচ্ছে সূচনাবিন্দুর আয় (Base income) যথেষ্ট নিচু ছিল। ফলে প্রবৃদ্ধির হারও বেশী ছিল। প্রাক স্বাধীনতা (১৯৬৮-৬৯) আমলের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ৭৪৪ টাকা (১৯৭৩-৭৪ বাজার দরে)। স্বাধীনতার পর দৃশ্যত দ্রুত গতির প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও এই পরিমান মাথাপিছু আয় অর্জন করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৮০-৮১ সাল পর্যন্ত। এথেকেই বোঝা যাচ্ছে যে আসলে এই সময়ের প্রবৃদ্ধি আসলে খুব আশাব্যঞ্জক ছিলনা। যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশ, দূর্ভিক্ষ এবং রাজনৈতিক উত্থান পতন ছিল এর পেছনের কারন।
১৯৮২/৮৩-১৯৮৯/৯০ এই দীর্ঘ সময়কালটি হচ্ছে স্থবিরতার সময় (A Decade of Stagnation by Abu Abdullah, UPL 1991)। এই সময়ের গড় প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৮১%। অর্থনীতিবিদরা অস্বচ্ছতা, দূর্নীতি, গণতন্ত্রহীনতা, পরনির্ভরশীলতার জন্য এই সময় কালের তীব্র সমালোচনামুখর।
এরপরের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে মোটামোটি একটি স্থিতিশীল নির্ভরযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। প্রথম গণতান্ত্রিক আমলে জিডিপির আনুষঙ্গিক বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে বাজার উদারীকরণ, ভর্তুকি প্রত্যাহার এবং তুলনামূলক বেশী বৈদেশিক অর্থায়ন। দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে অর্থনীতি ছিল মধ্য বামপন্থী, এসময় কৃষিতে ভর্তুকি বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক অর্থায়ন ছিল তূলনামূলকভাবে কম। তৃতীয় গণতান্ত্রিক আমলে (২০০৩-০৪) আমলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশী। বৈদেশিক বিনিয়োগের কিছুটা অনুকূল পরিবেশ এই প্রবৃদ্ধির সহায়ক ছিল। বিশ্বমন্দার সময়টাতেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যতটা কমে যাবার আশঙ্কা করা হয়ে ছিল ততটা কমেনি। এই দৃঢ়তার পেছনের কারন ছিল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং গার্মেন্টস সেক্টরের তুলনামূলক ভাল পারফরমেন্স। তবে বিনিয়োগের আস্থার পরিবেশ এই সময়টাতে (জরুরী অবস্থার সময়) ধরে রাখা সম্ভব হলে প্রবৃদ্ধি আরো বেশি হত। সর্বশেষ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫.৮৮% যার স্থিরিকৃত বাজারমূল্য ৩,৪০৬,৫২৪ মিলিয়ন টাকা (১৯৯৫-৯৫ মূল্যে) ।
বর্তমান সরকারের রূপকল্পে ২০১৩ সালে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৮% নির্ধারন করা হয়েছে। এই লক্ষমাত্রা অর্জনে যে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ দরকার তা দেশী বিদেশী যেকোন দিক থেকেই আসুক না কেন, তার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হচ্ছে জ্বালানি সমস্যার অতি দ্রুত সমাধান।
কৃষি
সারা পৃথিবীতেই মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান শিল্পের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। ফলে যদিওবা কৃষির প্রবৃদ্ধি বাড়ে তবুও ক্রমাগত জিডিপিতে কৃষির মোট অংশ কমবে। একটি দেশের জন্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বাস্থ্যকর রেসিপিটা হচ্ছে প্রথমে কৃষি বিপ্লবের সম্পুরক হিসেবে শিল্পায়নের পত্তন এবং পরবর্তীতে শিল্পের স্থিতিশীল অগ্রগতি এবং এর পিছে পিছে সেবা খাতের বিকাশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৃষি বিপ্লবের সম্ভাবনা আটকে গেছে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের ব্যর্থতার মুখে। এরপর শিল্পায়নের ধকটা ভালভাবে আয়ত্ত হবার আগেই সেবাখাতের দিকে অর্থনীতি হাঁটা শুরু করেছে।
আসুন দেখা যাক, আমাদের জিডিপিতে কৃষির পারফরমেন্স কেমনঃ

তথ্যসূত্রঃ ড. মাহাবুব হোসেন ও কাজী শাহাবুদ্দিন, ১৯৯৭
এই তথ্য আমাদের পূর্বের হাইপোথিসিস কেই প্রমাণ করছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির আপেক্ষিক অবদান সূচকীয় (exponential) হারে কমছে। কিন্তু এরকম হবার অবশ্যম্ভাবিকতাটি কী? এর পেছনের মূল কারণ হচ্ছে ভূমির পরিমাণ নির্দিষ্ট এবং জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তাই এই বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাহিদা পূরনে প্রকৃতি নির্ভর কৃষির উপর নির্ভর করা যাচ্ছেনা। ফলে শিল্পায়ন অনিবার্য হয়ে উঠছে।
এতো গেল জিডিপিতে কৃষির অবদানের কথা। কৃষির অভ্যন্তরীন (compositional) বিন্যাসও দারুনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। নিচের ডাটা থেকে ব্যাপারটা পরিস্কার হবেঃ



১৯৯০-৯১
জিডিপিতে কৃষির মোট অবদান ৩৭.৬%
কৃষিতে শস্যের % হার ৬৬.৭%
কৃষিতে বনজ সম্পদের % হার ১১%
কৃষিতে গবাদি পশুর অবদান ১১.১%
কৃষিতে মৎসের অবদান ১১.২%

২০০৭-০৮2200 ২০০৭-০৮
জিডিপিতে কৃষির মোট অবদান ২১.৯%
কৃষিতে শস্যের % হার ৫৫%
কৃষিতে বনজ সম্পদের % হার ১৩%
কৃষিতে গবাদি পশুর অবদান ১০%
কৃষিতে মৎসের অবদান ২৩%






তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন কৃষি শুমারি
এখান থকে দেখা যাচ্ছে ক্রমাগত আমরা শস্য থেকে অন্যান্য দিকে বিশেষত মাছের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। এছাড়া আমরা একফসলী প্রবনতার দিকে এগোচ্ছি। আগে শুষ্ক মৌসুমে যেসব রবি শস্য, পাট উৎপাদন করা হত তার বদলে ঊফসী ধান করা হচ্ছে। এতে ডালের যোগান কম হচ্ছে এবং চাহিদা মেটাতে ডাল আমদানী করতে হচ্ছে; ফলে দাম যাচ্ছে বেড়ে। এতে গরিবের প্রোটিনের ঘাটতি বাড়ছে।
বাংলাদেশের কৃষির জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হচ্ছে উৎপাদন উপকরন বাজার রেগুলেশনের আওতায় রাখা, সেচের জন্য বিদ্যুত এবং ডিজেল সরবরাহ নিশ্চিত করা, পরিবেশ বান্ধব এবং দেশী জাতের প্রাধান্য রক্ষা করে এমন প্রযুক্তিগত গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো এবং সমতাভিমুখী প্রবৃদ্ধির জন্য অবশ্যই ভূমি সংস্কার ও আবাদ যোগ্য জমির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা।
শিল্প ও সেবা খাত
স্বাধীনতার পরপর তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য সব দেশের মতই আমাদের সরকারও জাতীয়তাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্পের জন্য সংরক্ষনশীল নীতি অনুসরন করে। প্রত্যক্ষ পদ্ধতি যথা লাইসেন্সিং, কোটা, নিষিদ্ধ পন্য ইত্যাদির মাধ্যমে এবং পরোক্ষভাবে যেমন ট্যারিফ, বৈদেশিক বিনিময় নিয়ন্ত্রন, ঋণদান পদ্ধতি ইত্যাদির মাধ্যমে দেশি শিল্পকে রক্ষার চেষ্টা করে। এছাড়া শিল্পের জন্য প্রনোদনা ও সহায়ক ব্যবস্থাও গ্রহণ করে। শিশু অবস্থার জন্য এই পদ্ধতি সঠিক হলেও একটা সময়ে এসে শিল্পকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো শিখতে হয়, কিন্তু আমাদের দেশে নানা প্রতিবন্ধকতার কারনে বিশেষত মধ্য ৮০’র দশকে পরনির্ভর অর্থনীতির কারনে এই শিশু শিল্প দামড়া শিশুতে পরিনত হয়। এছাড়া শিল্পের বেসরকারীকরনের সময় ব্যাপক দূর্নীতি এবং অদক্ষতাও শিল্পখাতে অব্যবস্থার কারন। বর্তমানে শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬%। শিল্পের মোট মূল্য (১৯৫-৯৬ সালের স্থির মূল্যে) প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী জিডিপিতে শিল্পের অবদান ১৭.৭৮%। বর্তমান সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সাল নাগাদ এই প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। আমাদের শিল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ গার্মেন্টস এ আরো অনেক বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা একারনে রয়েছে যে সবচেয়ে বড় রপ্তানীকারক চীন খুব শীঘ্রই অন্যান্য শিল্পের দিকে সুইচ করবে এবং চীনের মজুরীও বাড়তির দিকে। তাই বাংলাদেশের বিদ্যুত, গভর্নেন্স সমস্যা এবং অবকাঠামোর সমস্যার সমাধানের দিকে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন করলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করে বাংলাদেশ প্রচুর বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে।
সেবাখাতের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে অগ্রগতি করেছে মোবাইল ফোন সেক্টর। তবে বাজারের আকৃতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর কারনে এই প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক ভাবেই ক্রমহ্রাসমান। এছাড়া পর্যটন, হোটেল,এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি, রেস্তোরা, ইত্যাদি হচ্ছে কয়েকটি বিকাশমান সেবাখাত। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের জন্য জিডিপিতে সেবা খাতের মোট অবদান ৫২.৩৩%।
মোবাইল টেলিফোনের অগ্রগতির চিত্র
সাল প্রবৃদ্ধি গ্রাহক সংখ্যা
২০০৪ ১১৭.৫৭% ৪১৫০৭৮৭
২০০৫ ১২৩.৩১% ৯২৬৯০৯৫
২০০৬ ১২৪.৪৪% ২০৮০৩৬৯৬
২০০৭ ৬৫.২৫% ৩৪৩৭৮৬৫৮
২০০৮ ৩৫% ৪৩৭০০০০০
তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯

বিদ্যুত ও জ্বালানী
যেকোন বিচারেই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুত ও জ্বালানি সমস্যা। মোটামোটি ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত ঘাটতি নিয়ে আমরা সকল খাতেই খোঁড়াচ্ছি। বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুত সংকট এত তীব্র, অথচ দেশের মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধার আওতায় এসেছে। তাই সবাইকে বিদ্যুত সেবার আওতায় আনা হলে এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে।
এখন গড় উৎপাদন ৩০০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি। নতুন কেন্দ্র চালু হলেও পুরানো কেন্দ্র গুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ভারতের সাথে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের যে চুক্তি করেছে তার সুফল পেতে ২০১২ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ততদিনে যে ঘাটতি দাঁড়াবে তাতে এই বিদ্যুত খুব বেশি সুফল আনবে না। সরকার রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে একটি পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করছে। এখান থেকে ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আসবে। চালুর অপেক্ষায় রয়েছে যেসব বিদ্যুত প্রকল্পঃ
সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং প্লান্ট-২ ১২০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা পিকিং প্ল্যান্ট ১৫০ মেগাওয়াট, ফেঞ্চুগঞ্জ সিসিপিপি ৯০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ (ভাড়াভিত্তিক) ৫৫ মেগাওয়াট, ফেঞ্চুগঞ্জ (ভাড়াভিত্তিক) ৫০ মেগাওয়াট, বগুড়া (ভাড়াভিত্তিক) ২০ মেগাওয়াট, সিলেট ১৫০ ও চাঁদপুর ১৫০ মেগাওয়াট
ক্রয় কমিটিতে অনুমোদনের পর চুক্তি হয়েছে বা চুক্তির অপেক্ষায় রয়েছেঃ
ভেড়ামারা ১০০ মেগাওয়াট, ঠাকুরগাঁও ৫০ মেগাওয়াট, নোয়াপাড়া ১০০ মেগাওয়াট, বরিশাল ৫০ মেগাওয়াট, গোপালগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, বেড়া ৭০ মেগাওয়াট, সান্তাহার ৫০ মেগাওয়াট, কাঁটাখালী ৫০ মেগাওয়াট, দোহাজারি ১০০ মেগাওয়াট, হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট, ফরিদপুর ৫০ মেগাওয়াট, দাউদকান্দি ৫০ মেগাওয়াট।(সূত্রঃ প্রথম আলো ২৯-০৩-২০১০)
তবে আমাদের যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি মনযোগী হওয়া দরকার তা হল সৌর বিদ্যুত। একথা সত্য যে এর প্রাথমিক খরচ খুব বেশি। কিন্তু এর চলার জন্য আলাদা কোন খরচ লাগেনা এবং বাংলাদেশে যে পরিমান সূর্যালোক পতিত হয় তার মাত্র ০.০৭% ব্যবহার করেই বাংলাদেশের বিদ্যুত চাহিদা মিটিয়ে ফেলা সম্ভব।
গ্যাস অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এজন্য যে, এটা অন্যান্য স্ট্র্যাটেজিক খাতের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এখন ১৭ টি গ্যাস ক্ষেত্র চালু আছে। সর্বশেষ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ী গ্যাস উৎপাদন হয়েছে ৬০০.৮৬ বিলিয়ন কিউবিক ফুট। এর মধ্যে বিদ্যুত এবং ক্যাপ্টিভ বিদ্যুতের জন্য ব্যায় হয়েছে ২৩৪.২৮ বিলিয়ন ও ৮০.৯৩ বিলিয়ন ফুট। সারের জন্য ব্যায় হয়েছে ৭৮.৬২ এবং শিল্পের জন্য ব্যায় হয়েছে ৯২.১৯ বিলিয়ন বিদ্যুত। শিল্পের জন্য বিদ্যুত ব্যবহারের প্রবনতা দেখে শিল্পায়নের হার সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পাওয়া সম্ভব।
মজুদ গ্যাসের প্রাক্কলিত পরিমান ১৫.৪১ টিসিএফ যা বর্তমান হারে ব্যবহৃত হতে থাকলে ২০১৫ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবার কথা। একদিকে আমাদের তীব্র জ্বালানী সংকট চলছে অন্যদিকে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান ও তা থেকে উৎপাদন ব্যহত রয়েছে। আবার তীব্র ঘাটতি সত্ত্বেও কেউ কেউ বিদেশে গ্যাস রপ্তানীর বুদ্ধি দিচ্ছেন!
নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে আরো গবেষনা এবং প্রায়োগিক উদ্যোগ ছাড়া জ্বালানী সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়া আঞ্চলিক সহযোগিতাও জ্বালানী নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।


আমাদানী-রপ্তানী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান
সর্বশেষ অর্থনৈতিক জরীপ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট আমদানীর পরিমান হচ্ছে ২৫২০৫ মিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানী ১৫৮৬৪ মিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি -৯৩৫৮.২ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানী করে যুক্তরাষ্ট্রে ২১৫১৪৬৫ মিলিয়ন টাকা এবং আমদানী করে সবচেয়ে বেশী চীন থেকে ২৬৮৮৯০ মিলিয়ন টাকা। সবচেয়ে বেশী আয় হয় তৈরী পোশাক রপ্তানী থেকে। বাংলাদেশের প্রধান আমদানী পন্য গুলোর শ্রেণী বিভাগ হচ্ছেঃ
ক) খাদ্য শস্যঃ চাল গম ও অন্যান্য শাক সবজি
খ) অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যঃ তেল, তৈলবীজ, দুগ্ধ, তামাক,মদ ও অন্যান্য পানীয়
গ)খনিজঃ খনিজ তেল, কেরোসিন, সাদা সিমেন্ট
ঘ)যন্ত্রপাতিঃ ভারী যন্ত্র, স্পেয়ার পার্টস, বিভিন্ন স্থল-জল-আকাশ পরিবহন
ঙ) অন্যান্যঃ সার, রাসায়নিক, চামড়া, কাগজ তৈরির মন্ড, সুতা, জুতা,ধাতু ইত্যাদি
রপ্তানী দ্রব্যগুলো প্রধানত দু’ধরনেরঃ
১) চিরায়ত পন্যঃ পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য, চা, নিউজপ্রিন্ট
২) অ-চিরায়ত পন্যঃ তৈরী পোষাক, চিংড়ি মাছ, ইউড়িয়া, বাইসাইকেল, পেট্রোলিয়াম এবং আরো কিছু ক্রমবর্ধিষ্ণু ছোট পন্য
রপ্তানীতে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে এটি মনো এক্সপোর্ট দেশ। কোন কারণে গার্মেন্টসের চাহিদায় বা উপকরন সরবরাহে কোন সমস্যা হলে সম্পূর্ণ রপ্তানী খাতে ধ্বস নেমে আসতে পারে। অবশ্য সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও আমাদের গার্মেন্টস শিল্প যথেষ্ঠ সক্ষমতা দেখিয়েছে।
অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও বাংলাদেশ যে অসাধারন পারফরমেন্স দেখিয়েছে তার পেছনের বড় কারন হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। ২০০৮-০৯ এর রিভাইসড হিসাব অনুযায়ী রেমিটেন্স এর পরিমান ৯৬৮৯.২৬ মিলিয়ন ডলার। এর ফলে ২০০৮-০৯ এর বছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭৪৭০.৯৬ মিলিয়ন ডলার। যা ২০০৭-০৮ সালে ছিল ৬১৪৮.৮২ মিলিয়ন ডলার। নিসঃন্দেহে বিশ্বমন্দার সময় রেমিটেন্সের এই উর্ধ্বমুখি প্রবনতা আশাব্যঞ্জক।
বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগঃ
২০০৮-০৯ সালে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৯৪১ মিলিয়ন ডলার। এই সময়ে নেট বৈদেশিক সাহায্য হচ্ছে ১০২২.৮৩ মিলিয়ন ডলার। সাধারনত বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, নতুন টেকনলজী প্রাপ্তি, প্রবৃদ্ধি ত্বরান্তিত করা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির আশায় বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রশংসা করা হয়, কিন্তু দেখা যাচ্ছে ২০০৯ সালের শেষে আমাদের দেশের ব্যংকগুলোর মোট তারল্যের পরিমান ৮০১২৮.৬০ কোটি টাকা। সুতরাং সঞ্চয় বিনিয়োগ ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা আদৌ নেই। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দেখতে হবে যে বিনিয়োগ কি শ্রমঘন হচ্ছে নাকি পুঁজি ঘন হচ্ছে। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস এর কারনে টেকনলজি ট্রান্সফার আদৌ সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া সাধারনত বিদেশী বিনিয়োগ আসে এবং মুনাফা করে আবার চলে যায়। পুনঃবিনিয়োগ খুব কম ক্ষেত্রেই হয়। তাই নেট ইনফ্লো না দেখে বলা যাবেনা যে আসলে আমাদের কেমন লাভ হচ্ছে। জনগুরুত্বপূর্ন খাত এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বৈদেশিক বিনিয়োগ সাধারনত Back to Back LC পদ্ধতিতে হওয়ার কারনে আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে না। উপরন্তু নানা শর্তের কারনে। বিদেশি কন্সাল্টেন্টদের পেছনে উচ্চাভিলাষী খরচ করতে আমাদের উদ্যোক্তারা বাধ্য হচ্ছে।
বৈদেশিক সাহায্যের ফলে বিভিন্ন আপদকালীন জরুরী অবস্থা মোকাবিলা করা গেলেও এটা একটা পরনির্ভরশীলতা তৈরী করে। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার মাত্র ৮% বাস্তবায়ন হয় বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে। অথচ সর্বদা এমন এক জুজু আমাদের তারা করে যে এটা ছাড়া আমরা যেন এক পাও চলতে পারিনা। অপরদিকে আমাদের সকল নীতিপ্রনয়নে দাতাগোষ্ঠী নাক গলানোর চেষ্টা করছে। স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি, পিআরএসপি ইত্যাদির মাধ্যমে তারা আমাদের ব্যায়ের খাত সংকীর্ণ ও নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। তাছাড়া বৈদেশিক সাহায্যে দানের পরিমানও ক্রমহ্রাসমান, বেশিরভাগই এখন ঋণ আকারে আসছে এবং এই ঋণও পরিশোধ করতে হচ্ছে চড়া সুদেঃ
সাল সাহায্যে দানের শতকরা পরিমান
১৯৭২-৭৩ ৯০%
১৯৭৯-৮০ ৫৩%
১৯৯৬-৯৭ ৪৯%
২০০১-০২ ৩৭%
২০০৭-০৮ ৩৩%
তথ্যসুত্রঃ মাহাবুবুল মোকাদ্দেম (২০০৩)
এছাড়া নেট ডিসবার্সড এইডের মধ্য থেকে সুদ পরিশোধ ও দেনা আদায় শেষে নেট এইডের পরিমান ক্রমাগত কমছে। ১৯৭৩-৭৫ সালে এটা ছিল শতকরা ৯৫% আর ২০০২ সালে এটা কমে হয়েছে ৫৯%।

মুদ্রাস্ফীতি, পুঁজিবাজার ও রাজস্ব ব্যবস্থা
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতিটা বরাবরই খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ওঠা নামা করে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের স্থিরিকৃত মূল্যে গত কয়েক বছরের মুদ্রাস্ফীতি দেখা যাকঃ
সাল মুদ্রাস্ফীতি খাদ্যমূল্য স্ফীতি
২০০৬-০৭ ১৭৬.০৬ ১৮৪.১৮
২০০৭-০৮ ১৯৩.৫৪ ২০৬.৭৯
২০০৮-০৯ ২০৬.৪৩ ২২১.৬৪
সূত্রঃ বাংলাদেশ ব্যাংক
উপরের ডাটা থেকে দেখা যাচ্ছে সবসময়ই খাদ্যমূল্য সাধারণ মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। অন্যান্য মূল্য হঠাৎ বেড়ে গেলেও কমার নজীর রয়েছে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের দাম একবার বাড়লে খুব কম সময়ই তা কমে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনও শক্ত কোন খুঁটির উপর দাঁড়াতে পারেনি। তবে উত্তরোত্তর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। বাজারের আয়তন যথেষ্ঠ ছোট। এর কারন হচ্ছে পন্য ও সেবা বাজারে ক্রিয়াশীল বিদেশী কম্পানীগুলোর অনুপস্থিতি। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী শেয়ার বাজারের মোট মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন হচ্ছে ১৮৮৪৪৯.৩০ কোটি টাকা যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৭৭.৮% বেশি।
বাংলাদেশের গত ২০০৯-১০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ছিল ৯৪,১৪০ কোটি টাকা যা জিডিপির ১৫.৩%। এডিপির (সংশোধিত) আকার ছিল ২৩,০০০ কোটি টাকা যা জিডিপির ৩.৭%। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট ঘাটতি ছিল জিডিপির ৪.১%; এর মধ্যে ২.৩% এর অর্থায়ন ছিল নিজস্ব এবং ১.৮% ছিল বিদেশী অর্থায়ন। ২০০৯-১০ অর্থবছরের এডিপির আকার হচ্ছে ৩০,৫০০ কোটি টাকা যা জিডিপির ৪.৪%।

দারিদ্র বিমোচন ও মানব উন্নয়ন
বাংলাদেশের দারিদ্র হচ্ছে একটি অন্যতম মুখরোচক বিষয়। বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনের বিভিন্ন মডেল নিয়ে বিশ্বব্যপী বিভিন্ন আলোড়ন সৃষ্টি হলেও ২০০৫ সালের হিসেব অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। বৈষম্য মাপা হয় গিনি কোএফিশিয়েন্ট (Gini Coefficient) দিয়ে। গিনির মান শূন্য থেকে একের মধ্যে হতে পারে। শূন্যমান বৈষম্যহীনতা এবং এক সর্বোচ্চ বৈষম্য নির্দেশ করে। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের গিনির মান হচ্ছে ০.৪৭।
অন্য দিকে মানব উন্নয়ন সূচকে ২০০৭-০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৪০ তম এবং মানব উন্নয়ন সূচকের মান ছিল ০.৫৪ যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর মান ছিল ভারত ০.৬১, পাকিস্তান ০.৫৫, শ্রীলঙ্কা ০.৭৪। এইমান ১ এর কাছাকাছি হলে সবচেয়ে ভাল মানব উন্নয়ন সূচক নির্দেশ করে।
দারিদ্র পরিমাপের ক্ষেত্রে এখন Cost of Basic Needs –CBN পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে শুধু ক্যলরী হিসেব না করে এর সাথে খাদ্য বহির্ভূত ভোগ্য পন্য অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। মাথা গণনা পদ্ধতিতে ২০০৫ সালে প্রত্যক্ষ ক্যলরি গ্রহণ (DCI) পদ্ধতিতে জাতীয় পর্যায়ে চরম দারিদ্র ছিল ১৯.৫% এবং অনপেক্ষ দারিদ্র ছিল ৪০.৪%। পল্লী অঞ্চলে এটার হার ছিল ৩৯.৫% এবং শহরাঞ্চলে তা ছিল ৪৩.২%। ২০০০ সালে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী জনগনের সংখ্যা ছিল ৫৫.৮ মিলিয়ন যা ২০০৫ এ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। নিচের পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশের দারিদ্র প্রবনতা দেখা যায়।


সসসাস ১৯৯১/৯২ ১৯৯৫/৯৬ ২০ ২০০০
জাতীয় ৫৮.৮৪% ৫১.৯% ৪৯.৮%
গ্রামীন ৬১.১৯% ৫৫.২% ৫৩%
শহুরে ৪৪.৮৭% ৪৯.৪% ৩৬%
তথ্যসূত্রঃ বিবিএস
ডাটা থেকে দেখা যাচ্ছে যে দারিদ্র কমার হার অত্যন্ত শ্লথ। দারিদ্র বিমোচনের মূলত ৩ ধরনের কৌশল বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়েছেঃ
ক) গতানুগতিক কৌশল এই কৌশল মূলত নয়া উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার একটি ব্যবস্থাপত্র। বাংলাদেশে এই কৌশল বাস্তবায়িত হয় Poverty Reduction Strategy Paper (PRSP) এর মাধ্যমে। এর উদ্যোক্তারা মনে করে প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে দারিদ্র বিমোচনের সর্বোত্তম কৌশোল এবং বৈষম্য যতই হোক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কিছুটা সুফল দরিদ্র জনগোষ্ঠী পাবেই। এছাড়া অর্থনৈতিক আদর্শের চিন্তার ক্ষেত্রে তারা মনে করেন শ্রমবাজারের গঠনগত কারনে কিছু লোক অবশ্যই দরিদ্র থাকবে।
খ) সংস্কারবাদী কৌশল
এই কৌশল কিছু সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনী, সামাজিক ব্যবসা তথা এনজিও ইত্যাদির মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করতে চায়। এরা কিছু নির্দিষ্ট গ্রুপ ভিত্তিক কাজ যেমন কাজের বিনিময়ে খাদ্য, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, ভিজিএফ, ক্ষুদ্র ঋণ ইত্যাদির মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব বলে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই কৌশল সবচেয়ে সফল।তবে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি মূলত চরম দরিদ্র ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি কেননা, তারাই ক্ষুদ্র ঋণ পায় যারা উদ্যোক্তা হওয়ার সামর্থ রাখে।
গ) বৈপ্লবিক কৌশল
এই কৌশলের প্রবক্তারা মনে করেন ভূমি, পুঁজি এবং জ্ঞানের অসম বন্টন ব্যবস্থা জিইয়ে রেখে দারিদ্র বিমোচন আদৌ সম্ভব নয়। এজন্য তারা মনে করেন সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভূমি সংস্কার এর সাথে উৎপাদন উপকরন বাজারের সংস্কার। এরা মনে করেন এনজিও গুলোকে গরীবের কর্পোরেশনে পরিণত করতে হবে। এছাড়া সামাজিক স্টক এক্সচেঞ্জের ধারণাও এদেরই অবদান। এরা মনে করেন চীনের পরিবার দায়বদ্ধতা মডেলের মত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর এক তৃতীয়াংশ মালিকানা শ্রমিকদের দিয়ে দেয়া যেতে পারে চুক্তির ভিত্তিতে। ফলে উদ্দ্বৃত্ত মুনাফা শ্রমিকরা পাবে। এরা মধ্যসত্ত্বভোগী দূর করতে উৎপাদক ও ভোক্তার আলাদা আলাদা সমবায় গড়ে তোলার পক্ষপাতি। এবং সবশেষে তারা প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা এবং মূদ্রা ব্যবস্থাপনার গুনগত পরিবর্তন চান যাতে দরিদ্ররা মূলধনের দেখা পায়।

শেষ কথা হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানব সম্পদ। সেই সাথে রয়েছে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাণ বৈচিত্র। মানব সম্পদে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক ও আপেক্ষিক উভয় সুবিধাই রয়েছে। সমন্বিত প্রয়াস এবং জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সকল নাগরিকের জন্য নূন্যতম শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হলে অমর্ত‌্য সেনের তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের দেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত রচনা করতে পারবে।