মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০১০

জনশক্তি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ঃ বর্তমান বাস-বতা


by আজহারুল ইসলাম

বিশ্ব অর্থনীতিতে “মন্দা” কথাটি বহুল আলোচিত ইস্যু যা উন্নয়নের চাকাকে বাধাগ্রস' করে চরমভাবে। যার অনিবার্য ধারাবাহিকতায় ২০০৮-০৯ সালের মন্দায় বিশ্বের সকল দেশ কম/বেশি ক্ষতিগ্রস' হয়। এতে বেকারদের সংখ্যা যেমনি বেড়ে যায়, তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স'বির হতে থাকে। খুদ যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৮ সালে ২৬ লক্ষ লোক কাজ হারায়। যুক্তরাষ্ট্রের “রিয়েল এস্টেট” সেক্টরটিতে ধস নামার মধ্যে দিয়ে মন্দায় যাত্রা শুরু হয়। এক পর্যায়ে বড় বড় কোম্পানি ব্যাংক দেওলিয়া হতে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব দ্রুত বিস-ার লাভ করে। বাংলাদেশও এই অনাকাঙ্খিত বাস-বতার বাহিরে নয়। বাংলাদেশের অর্থনীনিতে মন্দায় প্রভাবিত হয়েছে ; তবে তুলনামূলক কম। যাই হোক এখন আবার মন্দাভাব কাটতে শুরু করেছে। আনেক দেশ ুইধরষড়ঁঃচ নামে উদ্ধার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। অর্থনীতির চাকা আবার সামনের দিকে চলতে শুরু করছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মন্দা পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ছে এবং নতুন নতুন কর্মসংস'ান সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ যেখানে অফুরন- জনশক্তি বিদ্যমান, সেখানকার নীতি নির্ধারকদেরকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে “জনশক্তি রপ্তানির” দিকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। জনশক্তি রপ্তানির জন্য মধ্য প্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা বৃদ্ধি উচিত।
মালয়েশিয়া যে ৫৫ হাজার শ্রমিকের “কল ভিসা” বাতিল করেছিল তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। মোটকথা বর্তমান বাজারের সমপ্রসারনের সাথে সাথে নতুন শ্রম বাজারের অনুসন্ধান করতে হবে।
১৯৭৬-২০০৯ সাল পর্যন- যে সব দেশে শ্রমিক রপ্তানি বেশি হয় তাদের মাঝে- সৌদী আরবে ২৫.৭৩ লক্ষ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৫.৮৭ লক্ষ, মালয়েশিয়ায় ৬.৯৯ লক্ষ, কুয়েতে ৪.৮ লক্ষ, ওমানে ৩.৬১ লক্ষ, সিঙ্গাপুরে ২.৮০ লক্ষ। ৩৪ বছরে মোট ৬৭.৪১ লক্ষ শ্রমিক ২০ টিরও অধিক দেশে রপ্তানি করা হয়। তন্মধ্যে উপরে উল্লিখিত ৬ টি দেশে ৫৯.৮ লক্ষ তথা ৮৯% শ্রমিক রপ্তানি করা হয়েছে।
এতে বুঝা যাচ্ছে, অধিকাংশ শ্রমিক রপ্তানি অল্প কিছু দেশের মাঝেই সীমাবদ্ধ। যাতে ঝুুঁকিরও ব্যাপার রয়েছে। সে সব দেশ যদি বড় ধরনের অভ্যন-রীণ অথবা বাহ্যিক ক্ষতির মাঝে পড়ে তাহলে আমাদের ঝুঁকিটাও বেশি। তাই শ্রমিক রপ্তানির কয়েকটি দেশে সীমাবদ্ধ না রেখে এর ক্ষেত্র সমপ্রসারিত করতে হবে। আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গুরুত্বপূর্ন একটা অংশ রেমিটেন্স হিসেবে অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে আসে। যা অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি, বৈদেশিক বাণিজ্যে সহায়তা করে।
কিনু' আমরা যদি ২০০৭-০৯ সালের জনশক্তি রপ্তানির পরিমান দেখি তাহলে একটি হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠবে।
২০০৭ সালে ৮.৩২ লক্ষ, ২০০৮ সালে ৮.৭৬ লক্ষ এবং ২০০৯ সালে ৪.৭৫ লক্ষ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
২০০৯ সালে শ্রমিক রপ্তানি পূর্বের বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর পিছনে কিছু কারণও রয়েছে।
দ্ব প্রধানত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা।
দ্ব মন্দার ফলে অবকাঠামো উন্নয়ন সহ বিভিন্ন খাতে স'বিরতা চলে আসে।
দ্ব মালয়েশিয়ার ৫৫ হাজার “কল ভিসা” বাতিল করা সহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিক আমদানির প্রতি অনীহা প্রকাশ ।
দেশ ভিত্তিক বিবেচনা করলে শ্রমিক রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার চিত্রটি ফুটে উঠে। ২০০৯ সালে প্রধান ৬ টি দেশেই শ্রমিক রপ্তানি ২০০৮ সালের চেয়ে হ্রাস পায়। সৌদী আরবে ৯০%, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৮.৪% মালয়েশিয়ায় ৯০%, কুয়েতে ৯৬.৮৭%, ওমানে ২১% সিঙ্গপুরে ৩০% হ্রাস পায়।
অন্যদিকে আশ্চর্যজনকভাবে রেমিটেন্স এর দিক থেকে নতুন ইতিহাস তৈরী হয়। তা হলোঃ-
২০০৭ সালে ৬.৫৭ বিলিয়ন ডলার, ২০০৮ সালে ৮.৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০০৯ সালে ১০.৭২ বিলিয়ন ডলার তথা রেমিটেন্স দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এর কয়েকটি কারণ হতে পারে। যেমন ঃ-
্ম ব্যাংকগুলো বিশেষ সুবিধা দেওয়ার হন্ডিতে রেমিটেন্স পাঠানোর ঝুঁকি না নিয়ে বৈধ পথে পাঠাচ্ছে।
্ম শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
্ম মন্দার কারণে বিদেশে অর্থ জমা না রেখে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। (সুদ হার ব্যাপক কমার ফলে)
্ম অনেকে চাকরি হারানোর ফলে যা উপার্জন করেছিল সব নিয়ে দেশে চলে আসছে।


উপরের কারণগুলিই রেমিটেন্স বাড়ার পেছনে অবদান রেখেছে।
তবে যাই হোক না কেন, মন্দা পরবর্তী এই সময়ে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে ঃ-
্ম বর্তমান বাজারের সমপ্রসারন এবং নতুন বাজারের অনুসন্ধান।
্ম সঠিক তথ্য সরবরাহ করা যাতে কাজ নিয়ে বাহিরে যাওয়ার পর প্রতারণার স্বীকার না হয়।
্ম শ্রমিকদের কাজের ব্যাপারে ধারণা দেওয়া এবং সেই দেশের ভাষার জ্ঞান দেওয়া।
্ম শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ এর ব্যবস'া করা।
্ম যে সব দেশ শ্রমিক নেয়া বন্ধ রেখেছে তাদের সাথে কূটনৈতিক পর্যায়ে বৈঠক করে সমাধান করা।
্ম রিক্রুটিং এজেন্সির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
্ম নারীদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস'া নিশ্চিত করা।
্ম আদম ব্যাপারী বা দালালদের খপ্পর থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করা।
্ম বৈদেশিক কর্মসংস'ান নিয়োগ প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
্ম অভিবাসন ব্যয় হ্রাস করা এবং ঋণের ব্যবস'া করা।
্ম জনশক্তি রপ্তানি করার পর তাদের সমস্যার সমাধান করা।
্ম রেমিটেন্স পাঠানোর সহজ এবং নিরাপদ ব্যবস'া গ্রহণ করা।
্ম মৃত প্রবাসী কর্মীদের ফেরত আনা ও লাশ দাফনের সুষ্ঠু ব্যবস'া করা।
২০১০ সাল। নতুন বছর, নতুন ভাবে হাতছানি দিচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হচ্ছে। তাই শ্রম বাজারে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান সরকার দারিদ্য হ্রাস করে কর্মসংস'ান নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বাসী। তাছাড়া “ভিশন-২০২১” বাস-বায়নে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রুপান-র করা অপরিহার্য। আর এই বিপুল জনসম্পদকে দেশে কাজে লাগানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তাই সরকারের উচিত “দিন বদলের অঙ্গীকার, অভিবাসীর অধিকার, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার” স্লোগান কে সামনে রেখে, জনশক্তি রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার সময়োপযোগী ব্যবস'া গ্রহণ করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন