আজহারুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
azharecondu@yahoo.com
Written in 20.02.2010
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নতুন বছরে নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে চলছে। আর গ্রামীণ ফোন এসব রেকর্ডের পিছনে নিয়ন্ত্রকের আসন গ্রহণ করেছে। সূচক, লেনদেন বা মূল্য বৃদ্ধি যাই বলিনা কেন, তা যেন বেড়েই যাচ্ছে। ডিএসইর সাধারণ সূচক পাঁচ হাজার পেরিয়ে এখন ৫৭৬০.৯৪ (১৮.০২.১০)। যা জানুয়ারির ২১ তারিখের দিকেও ৫০০০ এর মত ছিল। লেনদেন দিন দিন বেড়েই চলছে। মূল্য বৃদ্ধিও ঘটছে অনেক কোম্পানির। সবমিলিয়ে সূচকের এই উর্ধ্ব গতি বলে দেয় শেয়ার বাজারে তেজিভাব চলছে বা বুলিশ ট্রেন্ড এ রয়েছে।
এসবের পিছনে যা কাজ করেছে তা হলো, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারের প্রতি “আশাবাদী” হয়ে পড়েছে। সবার মাঝে একটা অতিরিক্ত ‘স্পেকুলেশন’ কাজ করছে। অনেক নতুন বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজারে লেনদেন করার জন্য বিও (BO) বা বেনেফিশিয়ারী ওনার্স একাউন্ট খুলছে। তাদের চাহিদার সিকিভাগ শেয়ারও মার্কেটে আসেনি। তাই শেয়ারের চাহিদা এবং যোগানের মাঝে বিরাট অসমতা বিরাজ করছে।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ এর মতে, “আইপিওতে শেয়ার ছাড়ার যতো আবেদন ঝুলে আছে, তা দ্রুত বাজারে আনার ব্যবস্থা করা”। তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আংশিক বিরাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, “মেজরিটি শেয়ার সরকারের হাতে রেখে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।”
গত ১৩ জানুয়ারি, অর্থমন্ত্রী সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ৪৯ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার নির্দেশ দেন। এতে কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীন সব কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আমরা যদি সূচক, লেনদেন এবং মূল্য বৃদ্ধিতে গ্রামীণ ফোনের ভূমিকা দেখি তাহলে দেখবো- সূচক বৃদ্ধিতে গ্রামীণ ফোনের অবদান অনেক। বলা হয়ে থাকে, গ্রামীণ ফোনের শেয়ার দর এক টাকা বাড়লে সূচক তিন দশমিক শূন্য আট পয়েন্ট বাড়ে। মূল্য বৃদ্ধির দিক থেকে, জানুয়ারির ২৯ তারিখের দিকেও এ কোম্পানির শেয়ার মূল্য দুইশত ত্রিশ এর কোটায় ছিল। কিন্তু গত ১৭ ফেব্রুয়ারিতে এর মূল্য ৩৮৫.৪ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ গত একমাসে এর মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে ১৫৫ টাকার উপরে।
লেনদেনের দিক থেকে ডিএসই এবং সিএসই উভয় বাজারেই এর অবস্থান সব সময় শীর্ষ দশে। অধিকাংশ সময় শীর্ষ তিন এ। এসইসি (সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) পুঁজিবাজারের দ্রুত উর্ধ্বগতি নিয়ে চিন্তিত। কারণ, পুঁজিবাজার যখন অতিদ্রুত বৃদ্ধি পায়, তখন এর পতনও তত দ্রুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে অনেক (ক্ষুদ্র) সাধারণ বিনিয়োগকারীর মূলধন হারিয়ে সর্বশান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সমপ্রতি এসইসি পুঁজিবাজারে ¯^vfvweK গতি ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তা অনেকটাই পুঁজিবাজারের গতির চাকাকে ব্রেক কষে থামিয়ে দেওয়ার নামান্তর।
যেমন: পুঁজিবাজারে ঋণের প্রবাহ সংকুচিত করা।
প্রথমে নিয়ম ছিল, পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানির শেয়ারের বাজার মূল্য ও আয়ের অনুপাত বা পিই ৭৫ পয়েন্ট বা এর বেশি হলে, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউসগুলো সেসব শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ঋণ সুবিধা দিতে পারতোনা। পিই (P/E) হলো Price Earning Ratio তথা কোন শেয়ারের বর্তমান দামকে শেয়ার প্রতি আয় দ্বারা ভাগ করলে যা পাওয়া যায়। সর্বশেষ গত ০১ ফেব্রুয়ারী এসইসি নির্দেশনা জারি করে ০২ ফেব্রুয়ারী থেকে কোন
কোম্পানির পিই ৫০ এর উপরে থাকলে সে শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণ দেওয়া যাবেনা। এছাড়াও মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে তাদের গ্রাহকদের মার্জিন ঋণ প্রদানের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা ১:১.৫ থেকে কমিয়ে ১:১ করা হয়েছে। অর্থাৎ এই নীতিমালার পূর্বে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের পাঁচলাখ টাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা ঋণ দিতে পারতো। এখন পাঁচ লাখের বেশি দিতে পারবে না। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ক্ষেত্রে ১:২ থেকে ১:১.৫ করা হয়।
তাছাড়া ২৬ জানুয়ারি, সংবাদ সম্মেলন করে ডিএসই সভাপতি, অতিমূল্যায়িত শেয়ার না কেনার পরামর্শ দেন।॥
গ্রামীণ ফোনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি একটু বেশিই মনে হয়। কারণ, গ্রামীণ ফোনের শেয়ারের দর বৃদ্ধির পাশাপাশি পুঁজিবাজারে নতুন নতুন রেকর্ড জন্ম নিচ্ছে। পুঁজিবাজারের এই অবস্থার কারণে এসইসি গ্রামীণ ফোনকেই দায়ী করছে। এজন্য এসইসি সংবাদ সম্মেলন করে বিনিয়োগকারীদের অতি মূল্যায়িত শেয়ার না কেনার পরামর্শ দেওয়ার সাথে সাথে তিন সদস্যের কমিটি গঠণ করে গ্রামীণ ফোনের শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রিপোর্ট দাখিলের সময় বেঁধে দেয়। এসইসি এই দর বৃদ্ধির কারণ জানতে কোম্পানির নিকট নোটিশ পাঠায়। এতে করে এই দিন শেয়ার দর ৮.৪% কমে যায়।
এসইসি যখন পিই ৫০ পর্যন্ত ঋণসীমা বেঁধে দেয়, তখন গ্রামীণ ফোন ২০০৯ সালের শেষ প্রান্তিক তথা A‡±vei-wW‡m¤^i এর আন-অডিটেড আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তাদের আয় চারগুণ বাড়ার সংবাদ দেওয়া হয়। এতে করে তাদের শেয়ার প্রতি আয় পূর্বের ২.৫ টাকার স্থলে ১২.১ টাকায় দাঁড়ায়। যার ফলে বিনিয়োগকারীদের ঋণ পেতে সব সমস্যা দূরীভূত হয় এবং মূল্য আবার বাড়তে থাকে।এসবের মাঝে ০৮ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ফোনের ক্ষেত্রে এসইসি নেটিং “ফেসিলিটিজ” বন্ধ করে দেয়। এতে অন্য কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে লেনদেন নিষ্পত্তি হওয়ার আগে সমপরিমাণ টাকা দিয়ে গ্রামীণ ফোনের শেয়ার কেনার সুযোগ শেষ হয়। তবে গ্রামীণ ফোনের শেয়ার বিক্রি করে লেনদেন নিষ্পত্তি হওয়ার আগে অন্য কোম্পানির শেয়ার কেনার সুযোগ অবশিষ্ট থাকে। নেটিং হলো- কোন কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে বিক্রেতার একাউন্টে টাকা আসার পূর্বেই সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে অন্য কোম্পানির শেয়ার কেনার সুযোগ লাভ করা। এত কিছুর পরও গ্রামীণ ফোনের শেয়ার মূল্য বাড়ার সাথে তাল মিলিয়ে সূচকও বেড়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) তার সদস্যদের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রামীণ ফোনের শেয়ারের বিপরীতে ঋণ সুবিধা না দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, ডিএসই কোম্পানিটির তৃতীয় প্রান্তিকের ইপিএস ধরে পিই রেশিও দেখায় ৫৪। কিন্তু সর্বশেষ (চতুর্থ) প্রান্তিকের ইপিএস অনুযায়ী এর পিই ৩২। এর ফলে গত সপ্তাহের সর্বশেষ কার্য দিবসে সূচক এবং শেয়ার মূল্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ডিএসই’র ১৮ ফেব্রুয়ারি সাধারণ সূচক ৬৮ পয়েন্ট কমে ৫৭৬০ এ স্থির হয়। অন্যদিকে গ্রামীণ ফোনর শেয়ার মূল্য ২৪ টাকা (৬.২৮%) কমে ৩৬১ টাকা হয়। কিন্তু দেখার বিষয় সামনের দিকগুলোতে কী হয়!
তাই শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞবৃন্দ, বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার বাড়ানোর পরামর্শ দেন। আমরা দেখেছি, গ্রামীণ ফোনের আইপিও’র আবেদন জমা দেওয়ার বিশাল লাইন। এর কারণ-ভালো- মৌলভিত্তির শেয়ার মার্কেটে কম আসার পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কার্যক্রম প্রধান শহর ছাড়িয়ে জেলা শহর গুলোতেও বিস্তার লাভ করা। এতে সহজে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজারের সাথে যুক্ত হচ্ছে। তাই পুঁজিবাজারের এই উর্ধ্ব গতিতে হঠাৎ করে ধস নেমে যাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বশান্ত না হয়, সে জন্য এসইসিকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর তা হলো- শেয়ারের চাহিদার পাশাপাশি যোগান বাড়িয়ে চাহিদা ও যোগানের মাঝে ভারসাম্য স্থাপন করা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন